বাংলা নাটক এর দিন যে গেছে, একেবারেই কি গেছে? কিছুই কি নেই বাকী
মাহমুদুল হাসান সৌরভ:
বাংলা নাটক এর দিন যে গেছে, একেবারেই কি গেছে? কিছুই কি নেই বাকী…?
এককালে বাংলা নাটক, বিশেষ করে বাংলাদেশী নাটকের প্রশংসা ছিলো সর্বত্র। বাংলা নাটক নির্মাতা আর অভিনেতারা একসময় গর্ব করতেন এসব নাটক নিয়ে। কিন্তু গত কয়েক বছরে সেই চিত্র ম্লান হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে ২০০৮-০৯ পরবর্তী যেসব নাটক নির্মিত হয়েছে এবং বর্তমানে হচ্ছে তাতে বাংলা নাটকের গুণ বা কোয়ালিটি কতোটুকু পূর্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা সবাইকে ভাবাতে বাধ্য করছে।
বাংলা নাটক সম্বন্ধে জানতে হলে ঘুরে আসতে হবে একদম গোড়া থেকে। অর্থাৎ কীভাবে বাংলা নাটকের উদ্ভব এবং তার ক্রমবিকাশ সে সম্বন্ধে হালকা জেনে আসা যাক।
বাংলা নাটকের উদ্ভব মূলত দুইশত বছরেরও পূর্বে। তখন বাংলাদেশ সহ গোটা উপমহাদেশ মূলত উপনিবেশ শাসনের অধীন ছিলো। আর সেই কারণেই এই দেশের সংস্কৃতিতে পাশ্চাত্য ভাবধারা এবং তার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।
১৭৯৫ সালে রুশ নাগরিক লেবেডেক বাংলাদেশে প্রথম নাট্যশালা নির্মাণ করেন এবং তিনি তার ভাষা শিক্ষক গোলক নাথ দাসের দ্বারা অনুবাদ করিয়ে “লাভ ইজ দ্য বেস্ট ডক্টর” এবং “ডিসগাইজ” নাটকে অভিনয় করেন। আর লেবেডেকের অভিনয়ের পরেই ১৮৩৫ সালে নবীন চন্দ্র বসুর উদ্যোগে “বিদ্যাসুন্দর” নাটকটি অভিনীত হয় এবং ধরা হয় যে তখনই বাংলা নাটক তার নিজস্বতা প্রতিষ্ঠায় এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিলো।

মাইকেল মধুসূদন দত্তই ছিলেন প্রথম রচয়িতা যিনি বাংলা নাটকে সংস্কৃতের প্রভাব বর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মূলত তার রচিত “শর্মিষ্ঠা” (১৮৫৯) ছিলো স্বকীয় বাংলা নাটক যা এখনও অভিনীত এবং চর্চা হচ্ছে।এছাড়াও মধুসূদন “পদ্মাবতী” এবং “বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো” নামে দুটি সার্থক প্রহসন রচনা করেন যা নাটক রচনার জগতে নিজস্ব স্থান করে নিয়েছে।
মাইকেল মধুসূদনের পরেই যার নাম নিতে হয় তিনি হলেন দীনবন্ধু মিত্র। তার রচিত “নীল দর্পণ” (১৮৬০) বাংলা সাহিত্যে সর্বাপেক্ষা আলোড়ন সৃষ্টিকারী নাটক হিসেবে আখ্যায়িত করাই যায়!
এছাড়াও, মীর মশাররফ হোসেনের “বিষাদ সিন্ধু”, “জমিদার দর্পণ” সহ তার সাবলীল ভাষাশৈলী দিয়ে রচিত আরো নানান নাটক বাংলা নাট্যাঙ্গনকে করেছে অলংকৃত।
এরপরে আসে পৌরাণিক নাটকের রচনা। আর সেখানে জনপ্রিয় ছিলেন গিরীশ চন্দ্র ঘোষ। মূলত তিনি যেভাবে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীকে পুঁজি করে নাটক রচনা করেছেন সেগুলো সত্যিই প্রশংসার দাবীদার।
ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে শুরু করে টেলিভিশন আবিষ্কার এবং তা উপমহাদেশে আসা পর্যন্ত নাটক মঞ্চেই অভিনীত এবং উপস্থাপিত হতো। ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ত্যাগ করার পর পাকিস্তান শাসনামলে বাংলা ভাষা আন্দোলন সহ নানান অবস্থাতেই দেশের হাল সঙ্গীন ছিলো এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের যে দ্বন্দ্ব সেই দ্বন্দ্বের জের ধরেই তৎকালীন প্পূর্ব পাকিস্তান(বর্তমান বাংলাদেশে) সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের ওপর বিভিন্ন চাপ আসতে থাকে।
তখন রেডিও মূল প্রচার মাধ্যম হওয়ায় সেখানেই শাসকগোষ্ঠীর চাপ এবং নজরদারী ছিলো বেশি। এছাড়া মঞ্চ নাটক করাও তখন নানানভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিলো এবং স্থায়ী কোনো মঞ্চ না থাকার কারণে তখন বাংলা নাটকের চর্চা খুব দুরূহ হয়ে পড়েছিলো। এতো কিছু সত্ত্বেও সেই সময়ে কিছু গুণী মানুষ নাটকের চর্চা চালিয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- শওকত ওসমান, মুনীর চৌধুরী, আসকার ইবন শাইখ, আবুল ফজল, গোলাম রহমান এর মতো প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ যারা বাংলাদেশের নাটকের অন্যতম দিশারী।
১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয় মুনীর চৌধুরী রচিত নাটক “একতলা দোতলা”। পরিচালনা করেন মনিরুল আলম। তখন এই নাটকটি মঞ্চ নাটক হিসেবেই সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। কারণ তখন এডিটিং এর সুবিধে ছিলো না, ছিলো না আউটডোর ইকুইপমেন্ট বা শুটিংয়ের সুবিধা। কিন্তু এর মাধ্যমে বাংলাদেশে টেলিভিশন নাটকের সূচনা হয়েছে বলে ধারণা করা যায়।

কে ভুলতে পারবে সেইসব দিন যখন প্রতি সোমবারে বা বুধবারে বিশেষ নাটক প্রচারিত হতো। সেইসব নাটকে থাকতো মানুষের দুঃখের কাহিনী, পারিবারিক সম্প্রীতির কাহিনী। তখন ঘরে ঘরে খুব কম টেলিভিশন সেট ছিলো, পাড়ার সবাই মিলে বসতো ওই বিশেষ নাটক বা লোকমুখে পরিচিত “প্যাকেজ নাটক” দেখার জন্য। সেসব নাটক যেমনি রুচিশীল ছিলো তেমনি ছিলো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়! তখন প্রতিটি নাটক লেখা হতো মানুষের জীবনবোধের সাথে মিল রেখে, প্রতিটি নাটক বা প্রতিটি সংলাপই যেন ছিলো মানুষের ভেতরে লুকায়িত কথা।
আর এসব সম্ভব হয়েছিলো মুনীর চৌধুরীদের কল্যাণে, হুমায়ুন আহমেদ দের কল্যাণে, শহীদুল্লাহ কায়সারের মতো মানুষের লেখনীর মাধ্যমে! আরো সম্ভব হয়েছিলো “কানকাটা রমজান” খেতাবপ্রাপ্ত ঝানু অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীর কল্যাণে! রাইসুল ইসলাম আসাদ দের কল্যাণে, আফজাল হোসেন, সুবর্ণা মোস্তফা, গোলাম মোস্তফাদের কল্যাণে!
যে নাটক মানুষের মন দাগ কাটতে পারেনা, মানুষকে ভাবায় না সেই নাটক কেউই গ্রহণ করে না!
আচ্ছা, হুমায়ুন আহমেদ রচিত এবং পরিচালিত “কোথাও কেউ নেই” নাটকের বাকের ভাইয়ের চরিত্র মানুষের মনে যে দাগ কেটেছিলো তেমনটা কি এখনকার কোনো নাটকের চরিত্র দাগ কাটতে পারে? পারবে?
বাকের ভাই সেই চরিত্র যার ফাঁসির আদেশ হয়েছিলো নাটকের কাহিনীতে, আর এই চরিত্রের প্রভাব এতোটাই ছিলো যে তখন সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে স্লোগান দিয়েছিলেন এই বলে- “বাকের ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে…”
এই চরিত্রের প্রভাব এতোটাই ছিলো যে অভিনেতা আব্দুল কাদের তখন থানায় জিডি করতে বাধ্য হয়েছিলেন! আর হুমায়ুন আহমেদকে অতিরিক্ত নিরাপত্তা নিয়ে নাটকের শুটিং করতে হয়েছিলো…
নাটকের কথা একপাশে এবার আসা যাক অভিনেতাদের কথায়। নব্বই দশকে যেমন হুমায়ুন ফরিদী, আব্দুল কাদের, “বাকের ভাই” খ্যাত আসাদুজ্জামান নূর, “যুবরাজ” খ্যাত খালেদ খানেরা যখন পর্দা কাঁপাচ্ছিলেন তখন উদ্ভব হয় জাহিদ হাসান, শহীদুজ্জামান সেলিম, শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সারের দুই সন্তান সমু কায়সার-শমী কায়সার, আজিজুল হাকিমদের মতো তরুণ তুর্কীদের যারা তাদের আবেগ, জ্ঞান সমস্তটাই মিশিয়ে দিয়েছিলেন তাদের অভিনয়ে।
তখন রোমান্টিক জুটি হিসেবে তৌকির-বিপাশা, আফজাল-সুবর্ণা যেসব নাটক দর্শকদের উপহার দিয়েছেন সেগুলো রোমান্টিক হলেও ছিলো পরিবারের সাথে বসে দেখার মতো নাটক। সেগুলোর সংলাপ যেমন শালীন ছিলো, কাহিনী ছিলো রুচিবোধসম্পন্ন।
সেসব দিন আস্তে আস্তে হারিয়ে গেছে কিছু কাজের ফলে যেগুলো হয়েছে খুব সন্তর্পণে!
মূলত ২০০৫ সালের পর কিছু নির্মাতা তরুণদের লক্ষ্য করে কিছু নাটক নির্মাণ করেন যার ভাষা ছিলো একেবারে কথ্য ভাষা। নাটকগুলোর কাহিনী, চরিত্রায়ন ছিলো সম্পূর্ণ তারুণ্যনির্ভর।
এর ফলে নাটকগুলো তরুণদের মাঝে জনপ্রিয়তা পায় এবং চ্যানেল মালিকরা এবং নির্মাতারা সেসব নাটক তৈরি করে লাভবান হন। আর এই কারণে দেশী নাটক হতে মুখ ফিরিয়ে নেন বয়োজ্যেষ্ঠরা। তারা আকর্ষিত হন ভারতীয় সিরিয়ালের দিকে যার ফল এখন আমাদের চোখের সামনে!
বর্তমানে যেসব নাটক তৈরি হচ্ছে সেগুলোর কাহিনী কতোটুকু আকর্ষণ করে মানুষকে? আজকাল টিভি খুললেই দেখা যায় যে এমন কোনো কমেডি নাটক প্রচারিত হচ্ছে যেখানে কেন্দ্রীয় একটি বা দুটি চরিত্রই সারা নাটকে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে!
আর সবচাইতে ভয়ংকর বিষয় হলো ওসব নাটকের দৈর্ঘ্য এতোই বেশি যে দর্শক একই জিনিস বারবার দেখতে বিরক্ত হয়ে টিভি ছেড়ে উঠে যাচ্ছেন! আবার কিছু নাটক দেখা যায় এতোটাই আঞ্চলিক এবং কাহিনী নড়বড়ে কিন্তু সারা বছরব্যাপী মেগা সিরিয়াল হিসেবে প্রচারিত হয় কিন্তু কোয়ালিটি বা দর্শক টানার বেলায় সেগুলো সম্পূর্ণ ব্যর্থ!
শুধু এখানেই না, বর্তমানে কিছু প্রযোজক পরিচালক যখন টিভির পর্দায় এসে তাদের নাটক দেখার কথা বলেন, গুণগান করেন কিন্তু দেখার বেলায় মেলে অন্য কিছু! তারা এমন নাটকই তৈরি করেন যেখানে দর্শক কিছু বুঝে ওঠার আগেই নাটক শেষ হয়ে যায়! বা ভালোবাসার নাটক বা রোমান্টিক নাটক নামের এমন কিছু তৈরি করেন যেগুলো একেবারেই হয় ফেসবুককেন্দ্রিক নাহয় অপরিপক্ক অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বাড়তি ন্যাকামোর এক্সিবিশন!
দর্শক হয় সর্বস্তরের। একজন রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে কোটিপতি ব্যবসায়ী সবাই ই দর্শক। একজন রক্ষণশীল পরিবারের কর্তাও আজকাল টিভি সেটের সামনে বসেন কিছু দেখার জন্য, তিনিও যদি এই ন্যাকামোপূর্ণ অভিনয় আর রুচিহীন পোশাকের প্রদর্শন দেখেন তখন তিনি তো চাইবেন না সেই নাটক দেখতে!
এখন আমাদের দেশের নাটকের সংলাপ হয়, “ঠোঁটে কিস করতে বলেছি?” টাইপের। আর এমন নাটক দেখার চেয়ে না দেখাই ঢের ভালো!
অনেকেই দোষ দেন বিজ্ঞাপনের। হ্যাঁ, আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে এর মাত্রা ভয়াবহ! দেখা যায়, নাটক দেখানো হয় ১০ মিনিট আর ১৫ মিনিট বিজ্ঞাপন। এভাবেই ৪৫ মিনিট দর্শককে গুলিয়ে খাইয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বিজ্ঞাপন বাদে নাটকের যে গুণ সেটা নিয়ে কজনই বা কথা বলেছেন? কেউ কি ভেবেছেন পূর্বের সব অভিনেতা অভিনেত্রী কেনো নাটক ছেড়ে দিচ্ছেন?
কারণ একটাই, ভালো গল্প উঠে আসছেনা। রুচিশীল সংলাপ আসছেনা, ভালো পরিচালক আসছেনা। যা আসছে, আধুনিকতার নামে সব ডিজিটাল বর্জ্য! যেগুলো বর্তমান প্রজন্মের চিন্তা-চেতনাকে একেবারে পালটে দিচ্ছে। ভুলিয়ে দিচ্ছে নিজস্ব সংস্কৃতি।
এখন টিভি চ্যানেলগুলোতে ফেব্রুয়ারি মাস আসলে ভাষা শহীদদের কথা ভুলে বারবার প্রচারিত হয় “ভালোবাসার গল্প…কাছে আসার গল্প”। আর সেখানে কি দেখানো হয়? থাক! সেটা না বলাই ভালো।
দেশের নাটকের এই অবস্থায় এখনও অনেকে আশা করেন বাংলা নাটকের সেই সুদিন ফিরবে, আর সেজন্যে এখনও কিছু পুরনো সৈনিক নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এখনও বাংলা নাটক দেখার জন্য মানুষ টিভি সেটের সামনে পরিবার নিয়ে বসে, এখনও প্রতি ঈদে হানিফ সংকেত, তৌকির আহমেদ, মাহফুজ আহমেদ, তারিনদের নাটক দেখতে বসে মানুষ। মানুষ এখনও আশা করে বাংলা ভাষায় ইংরেজির টান যাতে বন্ধ হয়! কিন্তু সে অনুপাতে যেভাবে ভালো গল্প নিয়ে, ভালো ভাবনা নিয়ে, দেশের ঐতিহ্য-কৃষ্টি তুলে ধরে, ভালো অভিনয় দিয়ে কেউ এগিয়ে আসছে কি? আসলেও সেটি খুবই সামান্য!
আর এজন্যেই বলতে হয়,
“আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে? কিছুই কি নেই বাকি?”
লেখক : শিক্ষার্থী
এম.এস.এস (২০ তম ব্যাচ)
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
এম.এস.এস (২০ তম ব্যাচ)
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments