আধেয় বিশ্লেষণ কী । গণমাধ্যম গবেষণায় আধেয় বিশ্লেষণ পদ্ধতির ব্যবহার

 
 

আধেয় বিশ্লেষণ

অতি-আধুনিক কালে  সামাজিক গবেষণায় একটি নতুন পদ্ধতি হিসেবে আধেয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি যোগ হয়েছে। গণমাধ্যম গবেষণায় আধেয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি একটি নতুন মাত্রা তৈরি করেছে। গনযোগাযোগের সাথে সম্পর্কিত  বিষয় যেমন- প্রচারনা, বিজ্ঞাপন, অনুষ্ঠানমালার বিষয়, ধারা, স্টাইল, পরিবর্তন, গঠনযোগ্যতা বা গ্রহনযোগ্যতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আধেয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
এ পদ্ধতিকে দলিল নির্ভর পদ্ধতি বলা হয়ে থাকে। কারণ এখানে মূলত ‘documents’ বা যোগাযোগের যাবতীয় লিখিত বিষয়ের বিশ্লেষণ করা হয়।

বিশ্লেষণ বলতে কোন ঘটনা বা বিষয়কে ক্ষু্দ্রাতিক্ষুদ্র উপাদানে আলাদা আলাদা করে তাদের মধ্যে অান্তঃসম্পর্কের স্বরূপ নির্ণয় করাকে বুঝায়। যাতে বিষয়বস্তুর অারো গভীরে প্রবেশ করে এর পরিপূর্ণ চিত্র উদ্ধার করা যায়।

Analysis is the breaking down of an event or fact into smaller pieces in order to study it more closely.

আধেয় বিশ্লেষণতথ্য বিশ্লেষণ বলতে এমন প্রক্রিয়াকে বুঝায় যে প্রক্রিয়ায় গবেষণার মূল বিষয় শনাক্ত করা যায়। প্রাপ্ত তথ্য প্রস্তাবিত সম্পর্কানুমান সমর্থন করে কিনা তা পরীক্ষা করা যায়। এবং গবেষণা প্রশ্নের সমর্থনে সরেজমিন থেকে যে তথ্য প্রমাণ হিসেবে অাহরণ করা তা যথাযথ কিনা তার নানা রকম পরিসংখ্যানিক পরীক্ষা করা যায়।
কম্পিউটার অাবিষ্কারের পূর্বে ক্যালকুলেটরে বা হাতে গণনা করে সীমিত অাকারে  পরিসংখ্যানিক পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এখন কম্পিউটারের মাধ্যমে পরিসংখ্যানের নানা কৌশল তথ্যে প্রয়োগ করা যায় এবং অনেক জটিল সামাজিক প্রশ্নের তথ্য বিশ্লেষণ করা যায়।
Data analysis consists of running various tests on the data, often by hand computation or by means of desk calculators, but frequently by computer & apos; (Baily, 1978,p.307)

গবেষকরা তাদের বিশ্লেষণে সাধারণ ধারা উদ্ঘাটন করার উপর নজর রাখেন। গবেষণাধীন বিষয়ে কোন প্রকার সাধারণ রীতির পূর্বাভাষ অাছে কিনা সে সম্পর্কে ইঙ্গিত প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন।

তথ্য বিশ্লেষণবলতে এমন প্রক্রিয়াকে বুঝায় যে প্রক্রিয়ায় গবেষক:

১. গবেষণার বিষয়বস্তু (themes) উদ্ভাবনের জন্য বিষয়ভিত্তিক করে তথ্য শ্রেণীভূক্ত করে বিভক্ত করেন।

২. পর্যবেক্ষিত তথ্যের মধ্যে কোনো ধারা (patterns) পরিলক্ষিত হলে তা শনাক্ত করেন; এবং

৩. তথ্যানুযায়ী ধারণা ও সম্পার্কানুমান (hypothesis) গঠন করেন এবং

৪. বিষয় ও ধারণার সমর্থন দেখনোর জন্য যুক্তি উপস্থাপন করেন।

আধেয় বিশ্লেষণ এ মুখ্য করণীয়:


Miles and Huberman & apos ;s (1994)
এর মতে অাধেয় বিশ্লেষণের মৌলিক কাঠামো তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে-
ক. তথ্য সংকোচন
খ. তথ্য প্রদর্শন
গ. সিদ্ধান্তগ্রহণ

তথ্য সংকোচন:


বিশ্লেষণাত্বক পদ্ধতির মূল লক্ষই হলো তথ্যের সম্প্রসারণ। তথ্য সম্প্রসারণকে নিবিড় জ্ঞান অাহরণের প্রবেশদ্বার হিসেবে চিন্হিত করা হয়। গবেষকরা সচেতন হয়ে হয়তোবা বাহুল্য তথ্য পরিহার করার প্রচেষ্টা চালান, তবে বাহুল্য তথ্য কিছু চলে অাসতেই পারে।

লব্ধ তথ্যের মধ্য থেকে গবেষকরা বাহুল্য তথ্য ছাঁটাই করেন, সংশ্লিষ্ট তথ্য নির্ধারণ করেন, প্রকারভেদ করেন, বিন্যাস করেন, সহজীকরণ করেন, সংক্ষেপায়ন করেন, বিভাজন এবং গুচ্ছভুক্ত করেন।

তথ্য প্রদর্শন:

তথ্য উপস্থাপনের জন্য গবেষকরা তথ্য সারণি, তথ্য দিয়ে নানা ধরণের তথ্যচিত্র উপস্থাপন করেন। এসব সারণিতে বা চিত্রে বিভিন্ন ধারণার মধ্যে যোগসূত্রতা দেখানো হয়। সমাপ্তি টানার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট তথ্য বিভিন্ন সারণি ও চিত্রের সাহায্যে পরস্পরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়।

সিদ্ধান্তগ্রহণ:
গবেষকরাঅাস্ত বা সমগ্র” “যোগফলেরচেয়ে বৃহৎ- এই নীতির ভিত্তিতে তথ্য প্রদর্শন করেন এবং  ” তথ্যের বাহিরে গিয়েতত্ত্বায়ন বা সাধারণায়নের লক্ষ্যে নতুন অনুভূতি বা অর্থ উদ্ধার করেন।

 

গুণগত গবেষণায়  আধেয় বিশ্লেষণ

 
 
আধেয় বিশ্লেষণগুণগত গবেষণার তাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিত, বিষয়বস্তু, ও প্রশ্নের ধরণ এবং পদ্ধতি বৈচিত্র ও বহুমুখি। বিশেষণাত্বক গবেষণায় প্রবক্তারা মানব অাচরণকে প্রাসঙ্গিক অর্থ (contextual meaning of human action) উদ্ঘাটন  করাকে বিশ্লেষণের কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে করে।
গুণগত গবেষণায় তথ্য বিশ্লেষণের জন্য বহুল ব্যবহৃত বা স্বীকৃত মানের নিয়মাবলী তৈরি হয়নি।
এ প্রসঙ্গে Coffey and Atkinson (1996, pp10-11) বলেন,সুদৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরে তথ্য বিশ্লেষণ করার মতো কোন সুনির্দিষ্ট কোন কৌশল গুণগত গবেষণায় নেই। অালাপ-অালোচনা ও অর্থারোপ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে গুণগত তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করা হয়।

গুণগত গবেষণা প্রকল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিশ্লেষণের কাজ বিস্তৃত। গুণগত গবেষণায় গবেষক তথ্য সরবরাহকারী বা পর্যবেক্ষিত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অালাপ-অালোচনার মাধ্যমে তথ্যের তাৎপর্য, ব্যাখ্যা ও অর্থারোপ করে থাকেন।

এরুপ বিশ্লেষণ পন্থার জন্য গুণগত গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ নমনীয় (flexible)একই সঙ্গে বিশেষণাত্বক বিশ্লেষণ শৃঙ্খলাশ্রয়ী  (methodological), পান্ডিত্যপূর্ণ (scholarly),  বুদ্ধিবৃত্তিকতায় সুদৃঢ় ( intellectually rigorous)

গুণগত গবেষণায় তথ্য অাহরণ ও তথ্য বিশ্লেষণের কাজ একই সঙ্গে চলে। তথ্য অাহরণ ও তথ্য বিশ্লেষণের কাজ একই সঙ্গে চলে। তথ্য অাহরণ ও তথ্য বিশ্লেষণের কাজ অাবর্তনশীল- পুনঃপনিক কাজ- তথ্য অাহরণ ও তথ্য বিশ্লেষণের অগ্রগতি পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। তথ্য অাহরণ ও বিশ্লেষণের কাজ বৃত্তাকারে অগ্রসর হয়। এই ধারার বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় গবেষক পর্যবেক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করান।

যেহেতু তথ্য উপাত্ত শব্দে, বাক্যে, বক্তব্যে ও ভাবে প্রকাশ করা হয়,  সেহেতু গুণগত বিশ্লেষণে ভাষার বিভিন্ন গঠন ও বিন্যাস প্রণালী( forms and funcyions)  ব্যবহার করা হয়। mishler (1996) এই প্রণালীকে বলেন, ভাষা বিন্যাস কাঠামো (framework of linguistic function), অার halliday (1970, 1973) এটাকে বলেন, ব্যাকরণ তত্ত্ব।

জরিপ বিশ্লেষকরা তথ্য সংখ্যার সংকেতায়ন করেন এবং পরিসংখ্যানের কলাকৌশল প্রয়োগ করে বিশ্লেষণ করেন। এতে তারা অাসল,  স্বাভাবিক পরিবেশ,  পরিস্থিতি থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে ফেলেন।  এরকমটা গুণগত গবেষকরা করতে পারেন না।

তাদের গবেষণার ব্যাখা প্রদানে  ও তত্ত্ব প্রণয়নে অাচরণ বা ঘটনা থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে নিয়ে বিশ্লেষণ করার অার অন্য কোন বিকল্প পন্থা নেই। তাই গুণগত গবেষণায় তথ্য-উপাত্ত যে ভাষ্যে অাসে সেই ভাষ্যেই বিশ্লেষণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সেজন্য ভাষার প্রাধান্য ও ভাব প্রকাশের প্রাধান্য বেশি।

 

সংখ্যাত্বক গবেষণার আধেয় বিশ্লেষণ:


তথ্য সংগ্রহ শেষ হওয়ার পর, পূরণ করা প্রশ্নপত্র বা প্রশ্ন ফরদ হাতে অাসার পর তথ্য বিশ্লেষণের প্রস্তুতি শুরু হয়। তথ্য বিশ্লেষণে যাওয়ার অাগে প্রস্তুতি হিসেবে চারটি কাজ সম্পন্ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ-

ক. তথ্য পরিমার্জনা ও সম্পাদনা:

 সবগুলো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়েছ কীনা, কোন প্রশ্নের উত্তর বাদ পড়েছে কীনা, অন্য কোন প্রকার ভুল অাছে কীনা ইত্যাদি সনাক্ত করার জন্য উত্তরপত্র পুনঃপর্যালোচনা ও সম্পাদনা করা তথ্য পরিমার্জনা ও সম্পাদনার কাজ।

খ. তথ্য সংকোচন ও সংকেতায়ন: 

তথ্য সংকোচনের প্রধান কাজ উন্মুক্ত প্রশ্ন-উত্তরে প্রাপ্ত শব্দ বা বাক্য সংখ্যায় কোড করা।  কম্পিউটারের সাহায্যে প্রক্রিয়াজাত করার সুবিধার্থে তথ্য সংক্ষিপ্ত করা ও সংক্ষিপ্ত তথ্য সংখ্যায় কোড করা। প্রশ্নপত্র তৈরির সময় অথবা প্রশ্নপত্র পূরণ হয়ে অাসার পর এই দুই সময়ের যে কোন এক সময়ে কোডিং হতে পারে।প্রশ্নপত্র তৈরির সময় কোডিং করাকে প্রাক-কোডিং এবং পূরণ হয়ে অাসার পর কোডিং করাকে প্রশ্নপত্র পূরণোত্তর কোডিং বলে।
এতে দুটি প্রক্রিয়া জড়িত-
১. প্রত্যেক প্রশ্নের যে কয়টি উত্তর সম্ভব তাঁর প্রতিটির জন্য অালাদা সংখ্যা ন্যস্তরকণ এবং
২. প্রত্যেক সংখ্যার জন্য কম্পিউটারে নির্দিষ্ট অবস্থান নির্ধারণ।

গ. কোড বই তৈরি: 

যদি প্রশ্নপত্রেই প্রাক-কোডিং করা থাকে তাহলে নতুন করে কোড বই বানানোর প্রয়োজন হয় না। তবে প্রাক-কোডিং করা না থাকে তাহলে প্রশ্নপত্র পূরণের পর অবশ্যই কোড বই তৈরি করতে হয়।

ঘ. কম্পিউটারে তথ্য অন্তর্ভুক্তিকরণ: 
সমাজ বিজ্ঞানে তথ্য বিশ্লেষণের বহুল ব্যবহৃত প্যাকেজ Statistical Package for Social Science (SPSS) SPSS এর অাওতায় তথ্য অন্তর্ভুক্তির কাজ অনেক সহজ, এটা নিজে নিজেই তথ্য অন্তর্ভুক্তিতে সাহায্য করে।
এক্ষেত্রে প্রথমেই উত্তরদাতাকে শনাক্তকারী নম্বর দিয়ে শুরু করতে হবে। উল্লেখ্য, উত্তরদাতাদেরকে গবেষণার ভাষায়কেইস” (case) বা একক নমুনা (individual sample) বলা হয়। সকল কেইস থেকে প্রাপ্ত তথ্য সমষ্টিকে ডাটা সেট (data set) বলা হয়।




লেখক : শিক্ষার্থী
এম.এস.এস (২০ তম ব্যাচ)
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.