নন্দনতত্ত্ব । Aesthetics - সৌন্দর্যবিদ্যার এক বিস্তৃত আর বাস্তবিক ধরন
নন্দনতত্ত্ব / Aesthetics
নন্দনতত্ত্ব শুরু হোক গল্প দিয়ে,
গ্রীক মিথলজিতে সুন্দরের দেবতা ছিলেন নার্সিসাস। নিজের রূপলাবণ্যে তিনি এতই আত্নমগ্ন ছিলেন যে তিনি সবাইকেই অপমান করতেন। প্রেম প্রস্তাব দিলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন। প্রতিশোধের দেবতা নেমেসিস তাকে অভিশাপ দিলেন।
তাকে ভুলিয়ে পুকুর পর্যন্ত নিয়ে এলেন৷ পুকুরে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে ছুঁতে ছুঁতে আপনভোলা হয়ে সেখানেই ডুবে মরেন তিনি। একই জায়গায় পরে এক ফুলগাছ জন্মে। নাম হয় নার্সিসাস। নার্সিসাস অর্থ সুন্দর। ধারণা করা হয়,এখান থেকেই সৌন্দর্য, সৌন্দর্যতত্ত্ব ইত্যাদি অনুশীলনের শুরু।
নন্দনতত্ত্ব শব্দটি বাংলা ভাষায় এই গৃহীত হয়েছে সংস্কৃত সমাসবদ্ধ পদ থেকে (নন্দন বিষয়ক তত্ত্ব) √ নন্দ্ ( আনন্দ পাওয়া, আনন্দ দান করা) + অন্(ল্যুট) = নন্দন নন্দন শব্দের আরও একটি রূপতাত্ত্বিক রূপ রয়েছে। এই শব্দটি উৎপন্ন হয় ণিজন্ত √ নন্দি ক্রিয়ামূল থেকে।
√ নন্দি + ইন (ইনি) = নন্দন
এই বিচারে নন্দন শব্দের অর্থ দাঁড়ায়, যা থেকে আনন্দ পাওয়া যায় বা যার দ্বারা আনন্দ দেওয়া যায়, তাই নন্দন যেহেতু আনন্দের উৎস সৌন্দর্য তাই নন্দন শব্দের অন্য অর্থ হলো ― সৌন্দর্য প্রদায়ক। এই বিচারে নন্দনতত্ত্বের আভিধানিক অর্থ হলো- সৌন্দর্যপ্রদায়ক তত্ত্ব।
নন্দনতত্ত্ব শব্দটি প্রথম উল্লেখ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।’পরিচয়’ পত্রিকার ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ‘আধুনিক কাব্য’ নামক প্রবন্ধে তিনি একটি বাক্যে এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন এই ভাবে−
‘নন্দনতত্ত্ব ( Aesthetics ) সম্বন্ধে এজ্রা পৌণ্ডের একটি কবিতা আছে। বর্তমানে Aesthetics -এরবাংলা শব্দ ‘নন্দনতত্ত্ব’-ই প্রচলিত।

এর ইংরেজি Aesthetics, esthetics। এই শব্দটির উৎস গ্রিক। গ্রিক αἰσθητικός (aisthetikos , আইসথেটিকস), এর অর্থ হলো আমি অনুভব করি। এই শব্দটি প্রথম জার্মান ভাষায় গৃহীত হয়েছিল Æsthetik বানানে। ১৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জার্মান দার্শনিক আলেকজান্ডার গোট্ট্লিয়েব বমগার্টন (Alexander Gottlieb Baumgarten ) সৌন্দর্যবিদ্যার জন্য এই শব্দ ব্যবহার করেন।
নন্দনতত্ত্ব বা সৌন্দর্যতত্ত্ব একটি প্রাচীন শাস্ত্র; এর উৎপত্তি শিল্প সৃষ্টির প্রথম তৎপরতার সমসাময়িক।শিল্প মানবমনের আনন্দিত উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ এবং সেই শিল্পকে সৌন্দর্যের নানান দৃষ্টিকোণ থেকে পরীক্ষা বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয় যে শাস্ত্রে,তার নাম নন্দনতত্ত্ব। আবার অনেকে বলেন, বাংলায় নন্দন মানে হল “ছেলে” অর্থাৎ নন্দনতত্ত্ব মানে হল ছেলের তত্ত্ব । বাঙালি সমাজে বালকের বয়োপ্রাপ্তি এবং পাশের বাড়ির মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তার সৌন্দর্যকে আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় তার নান্দনিক বোধ ।
Western culture এ Aesthetics এর চর্চায় তিনটি বিষয়কে দেখা হচ্ছে, Feeling, Thinking এবং Exposure।কোন কিছুকে Aesthetic sense এ নেয়ার অর্থ হচ্ছে তা নিয়ে আমরা চিন্তা করছি,তা Feel করছি।সৌন্দর্যকে অনুভব না করে শুধু চিন্তায় এনে তা সুন্দরভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয় । একইসাথে সুন্দরকে চিন্তা , অনুভব ও তার প্রকাশই নন্দনভাবনা।
আলেকজান্ডার ব্যমগার্টেন বলেছিলেন যে, নন্দনতত্ত্ব হচ্ছে সেই শাস্ত্র যার বিবেচ্য বিষয় ইন্দ্রিয়ানুভূতিজনিত ও প্রয়োজননিরপেক্ষ সুখ দুঃখ ও তার প্রকাশ । এই সুখ দুঃখের প্রকাশে যে আনন্দ ও পুলকের সঞ্চার হয় তা আবার ইন্দ্ৰিয়নিরপেক্ষ ।
এই আনন্দ “কোনও চিন্তার আনন্দ নয়, কোন আকর্ষণ নয়, কোনও লিন্সা বা সঙ্গ নয়, কোনও ঐন্দ্রয়িক বা যান্ত্রিক বোধজনিতও নহে, অথচ ইহা দ্বারাই বস্তুচ্ছবিটি অন্য উদ্দেশ্যনিরপেক্ষ হইয়া জ্ঞানাকারে বিধৃত হইতে পারে ।”
Know More.
পৃষ্ঠাসজ্জা কি? পৃষ্ঠাসজ্জার গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য
সৌন্দর্যদর্শন বা নন্দনতত্ত্বের প্রধান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সৌন্দর্য। কিন্তু সৌন্দর্যকে কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায় আবদ্ধ করা কিংবা এর বিজ্ঞানভিত্তিক সার্বজনীন সংজ্ঞা প্রদান করা দুরূহ। কনফুসিয়াসের ভাষায়- ‘Everything has beauty, but not everyone sees it’. সৌন্দর্য কী, তা বর্ননা দিয়ে অপরকে বোঝানো যায় না, এটি অসংজ্ঞায়িত। সৌন্দর্য উপলব্ধির বিষয়, তাই এটি বুঝে নিতে হয়।
বার্গমান এর মতে- ‘সৌন্দর্যের বস্তুগত সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। সৌন্দর্যের অনুভূতি ঘটে শুধুমাত্র আত্মগতভাবে।’ নান্দনিক দিক থেকে সুন্দর বস্তুর পরিচয় হচ্ছে সৌন্দর্য,যার কোন কার্যকারণ নেই,কোন উদ্দেশ্য নেই,যা প্রয়োজন- অতিরিক্ত। সুন্দর সৌন্দর্য প্রকাশ করে। সুন্দরের পাশাপাশি অসুন্দরের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম, কেননা অসুন্দর হচ্ছে সুন্দরের উদ্বোধক।
সুন্দর বৈধ ও আকর্ষণীয় অসুন্দরের কারণেই। সুন্দর ও অসুন্দরের পাশাপাশি অবস্থান,ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া থেকেই নান্দনিক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। রূপকথার রাজকন্যা,ট্রয়ের হেলেন বা শকুন্তলার কথা বলি তা হলো ‘আদর্শসৌন্দর্যের’ প্রতীক, রূপকথার রাজপুত্র সেই সৌন্দর্যের সাধক।রূপকথার কাঠামো ও প্রতীকী যাত্রায় নন্দনতাত্ত্বিকের নিজস্ব যাত্রা ও পরিচয়টি লুকায়িত থাকে।
নান্দনিক নিজেও রূপের মধ্য দিয়ে রূপের অতীতকে, অসুন্দরের মধ্য দিয়ে সুন্দরকে আবাহন করে থাকে।সৌন্দর্যের অভাববোধকেই অসুন্দর বলা হয়। সুতরাং সৌন্দর্য প্রকৃতপক্ষে একটি মানসিক বোধ,যা জাগ্রত হয় ‘সুন্দরের’ সান্নিধ্যে।
সৌন্দর্য বিষয়টি সম্পূর্ণ আপেক্ষিক,যা স্থান- কাল-পাত্রভেদে পরিবর্তিত হয়। একজনের কাছে যা সুন্দর, অন্যজনের কাছে তা সুন্দর না- ও হতে পারে। একজনের কাছে নুসরাত ফারিয়া সুন্দর,অন্যের কাছে তা না-ও হতে পারে।
হিরো আলম আপনার আমার কাছে জনপ্রিয় না হলেও কোনো ক্ষেত্রে,কিছু দর্শকের কাছে পরিচিত প্রিয় মুখ। ভারতবর্ষের লোকজনের কাছে কালো হরিণ মায়াবী চোখ, কালো চুল সুন্দর কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে নীল চোখ, সাদা চুল সুন্দর।ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি,জাতি,আবহাওয়া,সভ্যতা, সংস্কৃতি সৌন্দর্যের ভিন্ন ভিন্ন মানদণ্ড তৈরি করেছে।
তবে নান্দনিকদের মতে, সৌন্দর্যবোধের তিনটি ধারা বা স্তর রয়েছে:
১)চোখে ভালো লাগার জিনিস সুন্দর হতে পারে; ২)প্রাণের ভালো লাগার জন্য এবং ৩)বুদ্ধির ভালো লাগার জন্য সুন্দর হতে পারে। তাই, বিশুদ্ধ চৈতন্য, আনন্দ, সৌন্দর্যবোধ, সমাজ ও ইতিহাস সচেতনতা, ব্যক্তি ও শিল্পী স্বতন্ত্র এসব প্রেক্ষিতে বিচার করলে নন্দনতত্ত্ব একটি বিশাল পরিধি।
Know More
জার্নালিজম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ
No comments