অবধারণগত অসঙ্গতি । Cognitive Dissonance
অবধারণগত অসঙ্গতি Cognitive Dissonance
সামাজিক মনোবিজ্ঞানের অন্যতম একটি তত্ত্ব হল অবধারণগত অসঙ্গতি তত্ত্ব। গণযোগাযোগ অধ্যয়ণেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। সামাজিক মনোবিজ্ঞানী লিওন ফেস্টিংগার ১৯৫০ সালে প্রথম এ তত্ত্ব উন্মোচন করেন। পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তত্ত্বটি প্রকাশ করেন। ফেস্টিংগারের ” When prophecy fails” গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়।
মানুষের বিশ্বাস, জ্ঞান বা চিন্তার সাথে যখন তাঁর করণ আচরণের পার্থক্য দেখা যায়, তখন তাকে অবধারণগত অসঙ্গতি বলে। অবধারণ শব্দের ইংরেজি cognition এর বিশেষণ হল cognitive, যা ল্যাটিন Cognito থেকে এসেছে। এর অর্থ হল ‘কোন কিছু জানা’ অর্থাৎ ব্যক্তির জ্ঞান। আর Dissonance শব্দের অর্থ অসঙ্গতি।
কোন একটা বিষয় যখন আমাদের জ্ঞান বা বিশ্বাসের সাথে না মেলে তখন আমাদের মধ্যে এক ধরনের অসংগতি শুরু হয়। আর এই অসংগতি দূর করতে আমরা নতুন যে আচরণ করি অথবা বিশ্বাসে যে পরিবর্তন দেখা যায় সেটাই হল অবধারণগত অসঙ্গতি।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় : আমাদের ভোজ্যতেলের কথা। রান্নাঘরে কাজ করবার সময় যদি কখনো হাত পিছলে তেল পড়ে যায়, তবে সে তেল আর উদ্ধার করে পুনরায় ব্যাবহারযোগ্য করা যায় না। এদিকে এটি একটি ক্ষতিও বটে। তবে যেহেতু তা আর ব্যবহার করা যাবেনা, তাই মানুষের মধ্যে এক ধরনের অসংগতি দেখা যায়। আর এই অসংগতি দূর করতে গ্রাম- বাংলার মানুষ নতুন এক বিশ্বাসকে সামনে নিয়ে এল। আর তা হল: তেল পড়ে গেলে সংসারে আয় বৃদ্ধি হয়। অসংগতি দূর করার জন্য এই নতুন চিন্তাধারাটিই হল অবধারণগত অসঙ্গতি ।

আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এর আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। যা আমরা আমাদের চারপাশে একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাই। যেমন- আমরা ছোটবেলায় সকলেই প্রায় শুনেছি যে, শিক্ষকের কাছে মার খেলে শরীরের যে স্থানে ব্যথা লাগবে সেই স্থান জান্নাতে প্রবেশ করবে। অর্থাৎ, দুষ্টুমি কিংবা পড়া না শেখার জন্য যদি শিক্ষকের হাতে মার খেতে হয়, তবে এর কোন প্রতিকার নেই। কেননা পড়া না শিখলে শিক্ষক শাসন করবেন এটাই স্বাভাবিক এবং এ বিষয়ে কেউ কিছু বলার নেই৷ কিন্তু, মার খাবার ফলে ছাত্রদের মধ্যে দু ধরনের বিষয় কাজ করে। এক, ব্যথা লাগে। দুই, সকলের সামনে মানহানি ঘটে। ফলে সে অসঙ্গতিতে ভুগতে শুরু করে। আর তা দূর করতে সে বলে বেড়ানো শুরু করে যে, শিক্ষকের হাতে মার খেয়ে ব্যথা পেলে, সে স্থান জান্নাতে যাবে। যা তার মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি নিয়ে আসে।
তত্ত্ব মতে বলা হয় যে, মানুষ অসঙ্গতি দূর করার জন্য এমন কিছু ভেবে নেয় যা তার অসঙ্গতি হ্রাস করে। এবং সে এটিকেই তার বিশ্বাসে পরিণত করে
এ তত্ত্ব নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনায় বিভিন্ন তাত্ত্বিক এর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। যেমন-
১. অসঙ্গতির মাত্রা :
সংখ্যাগতভাবে একজন ব্যক্তির অসঙ্গতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে এ ধারণার বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ, কোন একটা বিষয়ে যদি ব্যক্তির অসঙ্গতি দেখা দেয়, তা কী পরিমান অর্থাৎ ব্যক্তি কী পরিমান অসঙ্গতিতে ভুগছেন তা মেপে দেখার প্রক্রিয়ায় হল অসঙ্গতির মাত্রা বা Magnitude of dissonance। এই তত্ত্ব অনুযায়ী তুলনামূলক কম অসঙ্গতিপূর্ণ পরিস্থিতি ও বেশি অসঙ্গতিপূর্ণ পরিস্থিতিকে আলাদা করা হয়েছে।
এখানে অসঙ্গতি নির্ধারণের ৩ টি মাত্রা সংযোজন করা হয়েছে ( Zimbardo, Ebbesen & Maslach, 1977)। এগুলো হল:
ক) গুরুত্বের মাত্রা: অসঙ্গতিপূর্ণ পরিস্থিতি বা বিষয়টি ব্যক্তির নিকট কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা দ্বারা অসঙ্গতির মাত্রা নির্ধারণ করা যায়।
খ) অসঙ্গতির অনুপাত : ব্যক্তি কেবল নির্দিষ্ট একটি বিষয়েই অসঙ্গতিতে ভুগছেন, এমনটা হয় না। কেননা, তাঁর চারপাশে অনবরত হয়ে যাওয়া নানা ঘটনাই তাঁর মধ্যে অসঙ্গতিসৃষ্টি করে থাকে। তাই, অসঙ্গতির মাত্রা নির্ধারণে ব্যক্তি আশে পাশের আর কোন কোন বিষয়ে অসঙ্গতিতে ভুগছেন, তা জানাও জরুরি।
গ) যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা : এ কাজটি ব্যক্তি নিজে নিজেই করতে পারেন। যে বিষয়ে ব্যক্তি অসঙ্গতিতে ভুগছেন তার যৌক্তিকতা খুঁজে বের করেও অসংগতির মাত্রা নির্ধারণ করা যায়। যেমন: ব্যক্তি যে বিষয়ে অসঙ্গতিতে ভুগছেন তার চেয়ে আলাদা অন্য আরেকটি জটিল বিষয়ে চিন্তা কিরে ব্যক্তি তার অসঙ্গতির মাত্রা নির্ধারণ করতে পারেন।
এছাড়া আরো একটি তত্ত্ব এ আলোচনায় এসেছে। তা হল:
২. অসঙ্গতি কাটিয়ে ওঠা
অসঙ্গতি কাটিয়ে ওঠার জন্য এখানে তিনটি দিক নির্দেশ করা হয়েছে। এগুলো হল :
ক) সংগতিপূর্ণ বিশ্বাস সংযোগ করা।
খ) অসঙ্গতিপূর্ণ বিশ্বাস হ্রাস করা।
গ) বিশ্বাসে পরিবর্তন আনা।
৩. অনুধাবন ও অবধারণগত অসঙ্গতি
অবধারণগত অসংগতি তত্ত্বে মনে করা হয় যে, মানুষ তার অসঙ্গতি হ্রাস করার জন্য অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এড়িয়ে চলার এই প্রবণতার সাথে যে অনুধাবনগুলো জড়িত সেগুলো হল:
ক) Selective Exposure : অবধারণগত অসঙ্গতি তত্ত্বে মনে করা হয়, যেসব তথ্য ব্যক্তির অসঙ্গতি বাড়িয়ে দেয়, সেসব তথ্য সে এড়িয়ে চলে। বরং কিছু খুঁজে বের করে যা তাঁর আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সংগতিপূর্ণ।
খ) Selective Attention : মানুষ তার আচরণের সাথে, বিশ্বাসের সাথে সংগতিপূর্ণ বিষয়েই মনোনিবেশ করে থাকে।
গ) Selective Interpretation : মানুষ তার বিশ্বাসের সাথে সংগতি রক্ষার জন্য কিছু দ্ব্যর্থবোধক ব্যাখ্যা সৃষ্টি করে।
ঘ) Selective Retention : ব্যক্তি তার স্মৃতি দ্বারা এ ধরনের অসঙ্গতি দূর করতে পারে। অর্থাৎ, তার অতীত জ্ঞান কে কাজে লাগিয়ে সে এধরনের অসঙ্গতিপূর্ণ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারে।
মানবজীবনে অবধারণগত বলা যায় একটি অবশ্যম্ভাবী প্রক্রিয়া, যা নিয়মিত ঘটেই চলেছে। তাই এ বিষয়ে গবেষণাও হয়েছে বেশ। তবে অসঙ্গতি দূর করার বিভিন্ন উপায় সম্পর্কেও আমরা জেনেছি বিভিন্ন তাত্ত্বিকদের আলোচনায়।
লেখক : শিক্ষার্থী
মাস্টার্স (২২ তম ব্যাচ)
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments