প্রোটেস্ট্যান্ট নৈতিকথা এবং পুঁজিবাদের উত্থান

প্রোটেস্ট্যান্ট নৈতিকথা এবং পুঁজিবাদের উত্থান

সামাজিক চিন্তার ক্ষেত্রে মার্কস বস্তুুবাদী দর্শনের মাধ্যমে নতুন দৃষ্টিকোণের প্রবর্তন করেন। সে তত্ত্বকে তীব্রভাবে সমালোচনা করে যে সকল সমাজতত্ত্ববিদ নতুন অন্যদিকে সমাজের পরিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা করেন তাদের মধ্যে ম্যাক্স ওয়েভার অন্যতম। মার্কস যে সমস্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন । ওয়েবারও সে সমস্ত সমস্যাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হন।

ওয়েবারের মতে বা বিস্তর জগতে পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজেরও পরিবর্তন হয়।যেমন- সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদী সমাজে উত্তরণের ক্ষেত্রে ধর্ম, বিশেষ করে প্রোটেষ্ট্যান্ট ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পুঁজিবাদের উত্থানে ম্যাক্স ওয়েবারের তত্ত্ব

protestant ethic and The spirit of capitalism ওয়েবারের সবচেয়ে পরিচিত গ্রন্থ।এ গ্রন্থে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, কীভাবে প্রোটেস্ট্যানবাদে ( বিশেষ করে ক্যালভিনবাদ) পুঁজিবাদের উওরণে সহায়তায় করে। তিনি দেখানোর চেষ্টা করেন কীভাবে ধর্মীয় নীতিমালা এবং মূল্যবোধ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে প্রভাবিত করে।

ওয়েবারের প্রোটেষ্ট্যান্ট নৈতিকতার ফলে পুঁজিবাদের বিকাশ এই তত্ত্বটি প্রথম প্রকাশিত হয় (১৯০৪-১৯০৫)সালে প্রোটেষ্ট্যান্ট নৈতিকতা ও পুঁজিবাদের প্রেরণা নামে দুটি দীর্ঘ প্রবন্ধের আকারে।

ওয়েবার বলেন, শ্রেণী দ্বন্দ্বের কারণে বা উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের মাধ্যমে ইউরোপিয় সমাজ পুঁজিবাদের বিকাশ হয়নি। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক পূর্বেই পুঁজিবাদী চেতনা -প্রেরণা সৃষ্টি হয়েছে।

মার্কস বলেছিলেন, পুঁজিবাদের ফসল হল ধর্ম, ।

তিনি লক্ষ্য করলেন যে,পশ্চিমা সমাজের খ্রিষ্টানরা তাদের মৌলিক চাহিদা পুরণে ব্যর্থ হয় । ফলে সেখানে Lutheranism Calvinism তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটে। মার্কসে মতানুযায়ী পুঁজিবাদী সমাজের ফল হল প্রোটেষ্ট্যান্ট ধর্ম।

প্রোটেস্ট্যান্ট নৈতিকথা
প্রোটেস্ট্যান্ট নৈতিকথা

ওয়েবারের উদ্দেশ্য মাকর্স এর ধারণা কতটুকু সত্য তা পরীক্ষা করে দেখা। এ পরীক্ষা গিয়ে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হন।

তিনি বলেন যে,পুঁজিবাদের কারণে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের আবির্ভাব ঘটেনি বরং প্রোটেষ্ট্যান্ট ধর্মের কারণেই পুঁজিবাদী সমাজের বিকাশ হয়েছে।

তিনি পুঁজিবাদের যে সংজ্ঞা প্রদান করেন তাহল, Capitalism is a system of Profit-making enterprises bound together in market relations which has developed historically in many places and at various times.

অর্থ্যাৎ, বাজার ব্যবস্থার সাথে যুক্ত মুনাফা অর্জনকারী একটি উদ্দেশ্য হলো পুঁজিবাদ। যেটা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে ঐতিহাসিকভাবে বিকশিত হয়েছে।

প্রোটেস্ট্যান্ট নৈতিকথা ও পুঁজিবাদ

ম্যাক্স ওয়েবার প্রোটেষ্ট্যান্ট ধর্মের চারটি শাখার উল্লেখ করে আদর্শ জাতিরুপ হিসাবে ক্যালভিনবাদকে গ্রহণ করেছেন। অর্থ্যাৎ, তিনি ক্যালভিনবাদের নৈতিকতা বিশ্বাস এবং আচরণ কিভাবে পুঁজিবাদ বিকাশে সাহায্য করেছিল তা নির্দেশ করতে চেষ্টা করেছেন। তিনি ক্যালভিনবাদের কিছু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নীতিমালা তুলে ধরেন এবং এছাড়া বিশ্লেষণ করে পুঁজিবাদের সংগে এগুলোর সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেন।তিনি মূলত ক্যালভিনবাদের পাঁচটি মূল বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করেন ।

আরো জানুন……………..দাসপ্রথা, সামন্ততন্ত্র, পুঁজিবাদ | Slavery, Feudalism, Capitalism

যথা –

১. একজন চুড়ান্ত ও সর্বসময় বিধাতা অস্তিত্ববান আছেন। যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং নিয়ন্ত্রণ করছেন। মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে তাকে উপলব্ধি এবং তার নিকটবর্তী হওয়া সম্ভব না।

২. এই সর্বশক্তিমান ইশ্বর মানুষের পরিত্রাণ, প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তিকে নির্ধারণ করে রেখেছেন।

৩. ইশ্বর তার নিজ মাহিমার জন্য পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন।

৪. মানুষ তার ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নয়।বরং ইশ্বরের মহিমার ও ধরায় ইশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যেতে বাধ্য।

৫. মানুষের পরিত্রাণ প্রাপ্তি একমাত্র স্বর্গীয় স্বদিচ্ছাতেই সম্ভব।

প্রতিটি ধর্মেরই একটা উদ্দেশ্য হল পরজগতে নিবার্ণ লাভ করা। ক্যালভিনও প্রচার করেন যে, প্রতিটি মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন কাজ করা সেটা পর জগতে মুক্তি এনে দেবে। পৃথিবীতে যদি কোন কাজের সফলতা আসে তবে বুঝব,ইশ্বর আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট আছেন। আর যদি পার্থিব জগতে সাফল্য অর্জিত হয় তবে পর জগতে সাফল্য লাভ হবে।

ক্যালভিন এই পৃথিবীতে সফলতা অর্জনের জন্য তিনটি নীতির কথা বলেন । এগুলো হল যথা

১সময়ই অর্থ ( Time is money)

২ কর্মই ইশ্বর (work is god)

৩ আড়ম্বর জীবন যাপন (line on ascetic lite)

১ সময়ই অর্থ

ইশ্বর মানুষের জীবনকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এই সীমিত সময় খুবই মুল্যবান। আর এই মূল্যবান সময়কে অপচয় না করে। কাজে লাগাতে হবে। আর কাজ করলে কিছু না কিছু উৎপাদন হবে।

২ কর্মই ইশ্বর

ক্যালভিন নীতি অনুযায়ী কাজ করতে হবে ইশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য। সমাজের অন্য কেউ হলো কিনা সেটাই দেখায় ব্যাপার নয়।

৩.অনাড়ম্বর জীবন যাপন

পৃথিবীতে বিলাসিতা করার মত প্রচুর সময় হাতে নেই। তাই ব্যক্তিকে অতি সহজ সরল জীবন যাপন করতে বলা হয়।

এই নীতিমালা বিশ্লেষণ করে আমরা বলতে পারি, যদি কোন ব্যক্তি সময় নষ্ট না করে তবে কিছুনা কিছু উৎপাদন হবে। তবে সে কিছু না কিছু উৎপাদন টা শুধু পরিমাণের জন্য বলা হচ্ছেনা । উৎপাদন কোন কাজে ভুল এতটি থাকবে না। ফলে উৎপাদনের গুনগতমান বৃদ্ধি পাবে।যদি কোন ব্যক্তি সম্পদ ভোগ না করে অনাড়ম্বর জীবন যাপন করে। তবে তার পুঁজির সঞ্চয় হবে। যদি কোন ব্যক্তি সমাজ এ জাতি এই নীতি অনুসরণ করে তবে পুজির সঞ্চয় বৃদ্ধি পাবে।

আর সঞ্চয় মানই পুজিবাদের বিশ্বাস । প্রোটেষ্ট্যান্ট ধর্মের অনুসারীরা এই নীতি অনুসরণ করেছেন বলে সেখানে পুজিবাদের বিকাশ ঘটেছে। পক্ষান্তরে ক্যালভিনরা যে সব স্থানে বসবাস করেছে সেখানে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেনি। ভারত ও চীনে ধর্ম এ ধরনের নৈতিকতা সৃষ্টি করতে পারেনি। তাই এখানে পুজিবাদ বিকশিত হয়নি।

যদিও আধুনিক পুঁজিবাদের মূলপ্রেরণা এসেছিল ক্যালভিনবাদ থেকে পরবর্তীকালে পুঁজিবাদ তার নিজ শক্তির জোরেই তার ক্রমবর্ধমান বিকাশকে অব্যাহত রেখেছে। আবহমান কালের । ঐতিহ্যকে ভাঙ্গার এবং মানসিক শক্তিকে নতুন দিকে পরিচালিত করার ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ করেছিল প্রোটেষ্ট্যান্টবাদ।সাধারণ বিশ্বাসীদের মধ্যে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রবেশ করে প্রোটেষ্ট্যান্টবাদ যে শক্ত ভিত্তি স্থাপন করেছিল তার উপরই গড়ে উঠেছিল পশ্চিমের আধুনিক পুঁজিবাদ।

No comments

Powered by Blogger.