ইলেকট্রনিক উপনিবেশবাদ তত্ত্ব । Electronic Colonialism Theory

Shamsun Naher Bonna

ইলেকট্রনিক উপনিবেশবাদ তত্ত্ব

উপনিবেশবাদ বলতে একটি দেশ গণমাধ্যমের দ্বারা আরেকটি দেশের ওপর রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করাকে বোঝায়। মূলত , অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের জন্যই উপনিবেশবাদ গড়ে তোলা হয়। ব্যুৎপত্তিগতভাবে লাতিন কলোনিয়া থেকে ‘কলোনি’ শব্দটি এসেছে। যার আভিধানিক অর্থ কৃষি কাজের জায়গা।

‘কলিনস ইংরেজি অভিধান’ – উপনিবেশবাদ’কে দুর্বল মানুষ বা অঞ্চলগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটি শক্তির নীতি এবং অনুশীলন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে।

শাসনব্যবস্থা ও উপনিবেশবাদ কে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে-

১. সামরিক উপনিবেশবাদ (খ্রিস্টপূর্ব থেকে ১০০০খ্রিস্টাব্দ)

২. খ্রিস্টিয়ান উপনিবেশবাদ (১০০০ অব্দ থেকে ১৬০০ অব্দ)

৩. বাণিজ্যিক উপনিবেশবাদ (১৬০০ থেকে ১৯৫০ অব্দ)

৪.ইলেকট্রনিক উপনিবেশবাদ (১৯৫০ থেকে বর্তমান)




ইলেকট্রনিক উপনিবেশবাদ

সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য তত্ত্বের মতই ইলেকট্রনিক উপনিবেশবাদ তত্ত্ব শুরু থেকে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হিসেবে আলোচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৃতীয় বিশ্বের জন্ম হয় এবং বহু দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। ফলে ইউরোপীয় শক্তির উপনিবেশবাদের অবসান ঘটতে শুরু করে। ১৯৫০ এর দশকে পশ্চিমাদের সামরিক শাসন, প্রধান প্রধান বাণিজ্য সম্প্রসারণের পথ বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। সরাসরি বাণিজ্য পথ বন্ধ হলেও পশ্চিমারা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক পরিবেশকে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ওপর নির্ভর করতে উৎসাহ দেয়। নিত্যদিনের সকল প্রকার গণমুখী পণ্য আন্তর্জাতিকভাবে উৎপাদন শুরু করে উন্নত বিশ্ব। ইলেকট্রনিক কলোনিয়ালিজম দ্বারা উন্নত রাষ্ট্রগুলো নির্ভরশীল দেশগুলোর ওপর হার্ডওয়ার, সফটওয়্যার,ভাষা,সংস্কৃতি, মূল্যবোধ চাপিয়ে দিচ্ছে। যার ফলে অনুন্নত রাষ্ট্রের অনুসৃত অভ্যাস, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ পশ্চিমা দেশ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। নির্ভরশীল দেশগুলো নিজেদের স্বকীয়তা হারাচ্ছে। পশ্চিমারা তাদের তথ্যগুলো CD/DVD র মাধ্যমে ব্যাপক তথ্যভান্ডার দিয়ে তৃতীয় বিশ্বে তাদের মতাদর্শ প্রচার করতে পারছে। ইলেকট্রনিক উপনিবেশবাদের ফলে অনুন্নত দেশগুলোর অবস্থা এতই খারাপ যে তারা নিজেদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভুলতে বসেছে। মানুষের চাওয়া-পাওয়া, আচার-আচরণ, ইচ্ছা, বিশ্বাস, লাইফ স্টাইল নিয়ন্ত্রণ করছে ইলেকট্রনের উপনিবেশবাদ তত্ত্ব।

Electronic Colonialism মানুষের মনোজগতকে গ্রাস করে মৌলিক চিন্তাগুলোকে বদলে দিচ্ছে। সংস্কৃতি পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে শিখতে হয়। অথচ বর্তমানে সংস্কৃতি চালিত হচ্ছে মিডিয়ার দ্বারা। ভাষা, শিক্ষা,সংস্কৃতি অনুধাবন, অনুষ্ঠান ইত্যাদির সংমিশ্রণ ঘটছে। মিডিয়া-সংস্কৃতি মানুষের মূল্যবোধ, অনুধবনকে প্রভাবিত করছে।উদাহরণ হিসেবে বলা যায় – ESPN, CNN, MTV, Video Games, Internet ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা সংস্কৃতির বিকাশ ঘটছে। যার ফলে অর্থনৈতিক ফায়দাও লুটছে পশ্চিমা দেশগুলো। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যেমন – Disney, Sony, Viacom, News Corporation কাজ করে থাকে অভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ, এম্বেডিং সাংবাদিকতা অর্থাৎ একপক্ষীয় সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে। যাতে কনসার্ট সংস্কৃতি ,হলিউড সিনেমা, পাশ্চাত্য পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, ভাষার অনুকরণ করছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো।

মিডিয়ার ক্ষেত্রেও পশ্চিমা গোষ্ঠী তাঁদের অনুষ্ঠানমালা সস্তায় সরবরাহ করে বিধায় বাধ্য হয়ে দেশের মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচার করছে বিদেশ অনুষ্ঠানমালা।সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান কারিগরি ও অর্থের অপ্রতুলতার কারণে নিজেদের প্রোডাকশন করতে না পারায় বহুজাতিক কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এরকম প্রভাব দীর্ঘদিন মানুষের মাঝে বিদ্যমান থাকাই হলো ইলেকট্রনিক উপনিবেশবাদ। আর এই ধারণাকে যা বৈধতা দেয় তাই হলো ইলেকট্রনিক উপনিবেশবাদ তত্ত্ব।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য শক্তিশালী দেশগুলো প্রশাসনিক উপনিবেশবাদ তুলে নিলেও ইলেকট্রনিক উপনিবেশবাদ দেশগুলোকে পরোক্ষভাবে শাসন করছে। ঘরে বসে ব্যবসা সম্প্রসারণ, নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে বলে শক্তি প্রয়োগ থেকে সরে এসেছে উন্নত বিশ্ব। ইলেকট্রনিক কলোনিয়ালিজম এর যারা বিরোধী বা যারা ইলেকট্রনিক কলোনিয়ালিজম মেনে নিচ্ছে না , পশ্চিমা বিশ্ব সামরিক শক্তি জোট গঠন করে এবং তাদের উপর সামরিক শক্তি প্রয়োগ করছে।

Know More ………. তথ্যের অবাধ প্রবাহ । Free Flow of Information


ইলেকট্রনিক উপনিবেশবাদ তত্ত্বের ইতিহাস

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ প্রধানত মেইল এর মাধ্যমে হতো। সীমিত ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ছিল, কোনো আন্তর্জাতিক যোগাযোগ তত্ত্ব ছিল না। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের পরেই গণমাধ্যমের উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক বিস্তৃতি ঘটে। সারা বিশ্বের জন্য যোগাযোগের বার্তা পৌঁছানো ও সাংস্কৃতিক পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে বহু আন্তর্জাতিক মিডিয়া গড়ে উঠে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল রেডিও সহ আরো কিছু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় সংবাদ প্রচার করে।

শিল্প বিপ্লবের পর ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত বড় বড় পরিবর্তনে ইলেকট্রনিক উপনিবেশবাদ তত্ত্ব ভূমিকা রাখে। এতে প্রসার ঘটে জাতীয়তাবাদ,একীভূত উৎপাদন ব্যবস্থা, প্রযুক্তির বিনিময় এবং পশ্চিমা রাজনীতি ও অর্থনীতি। পশ্চিমারা তথ্য প্রযুক্তি ও কম্পিউটার ব্যবহার করে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে অনুন্নত দেশগুলোকে নির্ভরশীল করে ফেলে। যার ফলে যোগাযোগব্যবস্থা, জাতীয় সীমারেখা ও প্রযুক্তিগত বাধা দূর হয়ে যায় । এ পদক্ষেপগুলোই ইন্ডাস্ট্রিয়াল নন ইন্ডাস্ট্রিয়াল যেমন – মিলিটারি, ধর্মভিত্তিক ও বাণিজ্যিক উপনিবেশ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে।

১৯৮০-এর দশকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান গোটা উত্তর আমেরিকায় বেসরকারিকরণ, উদারীকরণ এবং বিনিয়ন্ত্রণের নীতি গ্রহণ করেন।কেবল উত্তর আমেরিকায় নয় , ইউরোপ জুড়েও এই নীতি প্রয়োগ হয়। পরে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এতে জোরালো সমর্থন দেন। এই নীতিতে বাজার জোরদার, বিনামূল্যে সেবা, মিডিয়া মার্জার, মালিকানাস্বত্বের ওপর জোর দেওয়ার ফলে বড় বড় মিডিয়া জায়ান্ট তৈরি হয়।

মূলত এরূপ সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ থেকেই ইলেকট্রনিক উপনিবেশবাদ তত্ত্বের জন্ম এবং প্রসার ঘটে

লেখক : শিক্ষার্থী

মাস্টার্স , যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা ‍বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.