যোগাযোগ নীতিমালার মূলনীতি সাধারণ । Principles of Communication Policy

যোগাযোগ নীতিমালার মূলনীতি সাধারণ General principle of communication policy

১৯৭৬ সালে সানহোসে সম্মেলনে যোগাযোগ নীতিমালার প্রধান উদ্দেশ্যসমূহ ছাড়াও কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট সাধারণ মূলনীতি বেরিয়ে এসেছে।

 যোগাযোগ নীতি প্রণয়নের সময় এগুলো বিশেষভাবে মনে রাখা উচিত। সানহোসে সম্মেলনে ১৩ টি সাধারণ মূলনীতির কথা বলা হয়েছে।

যোগাযোগ নীতিমালার মূলনীতি
যোগাযোগ নীতিমালার মূলনীতি

যোগাযোগ নীতিমালার মূলনীতি

১. সামাজিক দায়িত্ব নির্ধারণ

২. সামাজিক কার্যক্রম বিবেচনা করা

৩. জনগণের চাহিদা নির্ধারণ

৪. অভিগমন ও অংশগ্রহণ

৫. সমস্যা ও প্রশ্ন বিবেচনা

৬. সংগতিপূর্ণ সম্পর্ক

৭. কৌশল সৃষ্টি ও বিকেন্দ্রীকরণ

৮. পরিচিতি ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ

৯. সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধ

১০. পশ্চাদপসরণ রোধ

১১. যেমন দেশ তেমন নীতি

১২. সকল খাতের অংশগ্রহণ

১৩. সংগঠন ও কর্মপন্থা প্রতিষ্ঠা

Learn More …….. বাংলাদেশের জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা বিশ্লেষণ

১. সামাজিক দায়িত্ব নির্ধারণ 

 যোগাযোগ সম্পর্কে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে বিভিন্ন উপাদানের সামাজিক দায়িত্বের বিষয়টি নির্ধারণ করতে হবে। মৌলিক আইন দ্বারা স্বীকৃত মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুষ্ঠু চর্চা করতে এটা খুবই জরুরী। সরকারী দায়িত্বের মধ্যে যেমন সরকারী কমিশন গঠন, পার্লামেন্টে আলোচনা, অর্থ যোগান দেয়া ইত্যাদি। আর বেসরকারী সংস্থাগুলো জনগণের প্রয়োজনসমূহকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সাজিয়ে তা সরকারের কাছে উপস্থাপন করতে পারে।

২. সামাজিক কার্যক্রম বিবেচনা করা 

 সকল যোগাযোগ মাধ্যম কে তাদের সামাজিক কার্যক্রমের পটভূমিতে সাধারণভাবে এবং সুনির্দিষ্টভাবে বিচার করা দরকার। অর্থাৎ যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে সামাজিক প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে সাধারণ এবং সুনির্দিষ্টভাবে তাদের ভূমিকা কি থাকবে তা নির্দিষ্ট করতে হবে। যেমন – BTV শিক্ষা কার্যক্রমকে উৎসাহিত করবে এটা সাধারণ নীতি আর সুনির্দিষ্ট মানে BTV কে প্রতিদিন ১ঘন্টা প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ক কার্যক্রম সম্প্রচার করতে হবে। আবার এ বিচার বিবেচনা হবে সকল মাধ্যমের এক সঙ্গে আবার কখনো বিভিন্ন মাধ্যমের আলাদাভাবে। কারণ সকল মাধ্যমের সামাজিক কার্যক্রম একনয়।যেমন মুদ্রণ মাধ্যমের সামাজিক কাজ রেডিও – টিভি বা চলচ্চিত্র থেকে আলাদা।

৩. জনগণের চাহিদা নির্ধারণ 

 যোগাযোগ নীতিমালা প্রণয়নের সময় গণযোগাযোগ বিষয়ে জনগণের প্রকৃত প্রয়োজন বিবেচনা করা উচিত। প্রয়োজনে গবেষণার মাধ্যমে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে জনগণের চাহিদা নিরূপণ করতে হবে। যেমন: জনগণ শুধু সরকারীদলের সংবাদই চায়না, তারা উন্নয়নমূলক সংবাদ, বিরোধীদলীয় সংবাদ চায়। করাচীতে theatre for development এ দেখা গেল তারা drug addiction প্রতিহত করার কথা বলে।

৪. অভিগমন ও অংশগ্রহণ 

 যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় বেশিমাত্রায় জনগণের প্রবেশাধিকার এবং পূর্ণমাত্রায় তাদের সর্বাধিক অংশগ্রহণের বিষয়টিকে নিশ্চয়তা দেয়া দরকার। যেমন – ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান ঢাকার লোক দিয়ে অনুষ্ঠান করা হয় কিন্তু উচিত বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিভিন্ন লোক দিয়ে অনুষ্ঠান সাজানো। কারণ এতে জনমনের প্রতিফলন ঘটে, জনসচেতনতা বাড়ে এবং অনুষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।

৫. সমস্যা ও প্রশ্ন বিবেচনা 

 যোগাযোগ নীতি প্রণয়নের সময় স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেমন প্রযুক্তিগত সমস্যা দেখা দেয় এবং অন্যান্য যেসব বিতর্কিত প্রশ্নের উদ্ভব হয় সেগুলোকে বিবেচনায় আনা উচিত। অর্থাৎ সকল পর্যায়ে নতুন যোগাযোগ প্রযুক্তিগত জটিলতা নিরসন করতে হবে। যেমন – স্থানীয় পর্যায়ে বিদ্যুতের অভাবে অনেক গ্রামের লোক স্যাটেলাইট টিভি দেখতে পারে না। জাতীয় সমস্যা হল বাংলাদেশের নিজস্ব সার্ভার নেই। আর আঞ্চলিক পর্যায়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে পর্নোগ্রাফি আসছে তা বিশাল সমস্যা সৃষ্টি করছে।

৬. সংগতিপূর্ণ সম্পর্ক 

 সামগ্রিক যে উন্নয়ন পরিকল্পনা করেছে তার সাথে যোগাযোগ নীতি সংগতিপূর্ণ হতে হবে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে এগুলো যাতে সাংঘর্ষিক নাহয়। লক্ষ্য ও কৌশলের সাথে এবং যোগাযোগ পরিকল্পনা ও সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক আণয়নের পন্থা খোঁজা উচিত। এগুলো পরস্পর ভিন্ন ধারার হলে চলবেনা। এগুলির সাথে যেন দ্বন্দ্ব না হয় তার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। যেমন লক্ষ্য হল মুক্তবাজার অর্থনীতি আর কৌশল হল ইপিজেডকে সাবসিডি দেয়া হবেনা। আবার যোগাযোগ নীতির প্রায়োরিটি ও ন্যাশনাল প্রায়োরিটির মাঝে যেন মিল থাকে নতুবা মিনিস্ট্রি কোন টাকা দিবেনা। জাতীয় পরিকল্পনা যদি থাকে গণমাধ্যমের জাতীয়করণ তখন যোগাযোগ নীতি করে বিশেষ কোন ফল হবেনা।

৭. কৌশল সৃষ্টি ও বিকেন্দ্রীকরণ 

 বিভিন্ন সামাজিক খাত সমূহ যেমন – স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি এর মধ্যে যথাযথ সুসংহতি নিশ্চিত করা দরকার। এবং এটি করতে গিয়ে যা করা দরকার তা হল সমন্বিত কার্যক্রমের জন্য কর্মকৌশল সৃষ্টি করা এবং অংশগ্রহণের মূলকেন্দ্রসমূহকে বিকেন্দ্রীকরণের চেষ্টা করা। অর্থাৎ অন্যান্য যোগাযোগ নীতি কে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোকে কমিশনের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। ক্ষমতা শুধু কেন্দ্রে সীমিত না রেখে ছড়িয়ে দিতে হবে। ক্ষমতা যত বিকেন্দ্রীকৃত হবে অংশগ্রহণ তত বেশি হবে। রেডিও, টিভি, সংবাদপত্র কে আঞ্চলিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে।

৮. পরিচিতি ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ 

 রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক পরিচিতি, স্বকীয়তা এবং সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ করতে হবে। নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য যেন কখনও হুমকির সম্মুখীন না হয় সেই খেয়াল রাখতে হবে। যেমন – শ্রীলঙ্কাকে একসময় বলা হতো media operation এর ক্ষেত্রে সম্ভবনাময়। কিন্তু সিংহলীকে রাষ্ট্রভাষা করা হলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। রেডিও টিভি তে অনুষ্ঠান হয় সিংহলীতে। এতে তামিলরা ক্ষেপে যায়। তাই এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে সাংস্কৃতিক পরিচিতি ক্ষুন্ন হয়। হুমকি শুধু বাহিরে থেকে নয় ভেতর থেকে ও আসতে পারে।

৯. সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধ 

 সেইসব ব্যবস্থার উপস্থিতি রোধ করা দরকার যেগুলো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সৃষ্টি করে, প্রযুক্তিগত নির্ভরতা তৈরি করে এবং সমাজের ভোগ অভ্যাসের বিকৃতি সাধন করে। জনগণের প্রচার মাধ্যম ব্যবহার পদ্ধতি পরিবর্তিত হয় এমন কোন পদক্ষেপ নেয়া যাবেনা।

যেমন – ডিশ এন্টেনা, ভিসিআর এগুলো স্থানীয়ভাবে কার্যকর হয়না। যে সকল ছায়াছবি আমাদের আমাদের সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় তা প্রতিহত করতে হবে। আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোর শৈল্পিক মান বৃদ্ধি করতে হবে। আর প্রযুক্তিগত নির্ভরশীলতা একশভাগ কমানো সম্ভব নয়।

৮০’র দশকের সনে করা হতো যার স্যাটেলাইট আছে সে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু এখন স্যাটেলাইট ভাড়া করে কার্যক্রম চালানো যায়। ফলে অন্য দেশের প্রতি নির্ভরশীলতা কমছে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি একটি স্যাটেলাইট ভাড়া করার কথা ঘোষণা করেছেন।

১০. পশ্চাদপসরণ রোধ 

 অনুরূপভাবে অনুন্নয়ন নির্ভরতা এবং সামাজিক অন্যায় – মনোভাব – দৃষ্টিভঙ্গির ফলে সৃষ্ট অবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে চায় এমনসব সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচার কাঠামোকে যোগাযোগ নীতিতে আরোপ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

অনিয়ম, দুর্নীতি, কুসংস্কার চিহ্নিত করে সে সম্পর্কে জনগণকে সজাগ থাকতে হবে। মিডিয়াকে এটা করতে চিন্তা চেতনা, মূল্যবোধ, চাহিদা, দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করে প্রত্যেক দেশের যোগাযোগ নীতি ও পরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে।

১১. যেমন দেশ তেমন নীতি 

 এটি স্বীকার করা উচিত যে নিজ দেশের বৈশিষ্ট্যের সাথে সংগতি রেখে যোগাযোগ নীতিমালা ও পরিকল্পনা নির্ধারণ করার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দেশের নিজস্ব ব্যাপার। যেমন – বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগ নীতি একই হবেনা কারণ দুটি দেশের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।

১২. সকল খাতের অংশগ্রহণ 

 যেসব খাত যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় অথবা যাদের সাথে যোগাযোগ প্রক্রিয়ার প্রভাব আছে যোগাযোগ নীতিমালায় তাদের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও দায়িত্বের বিষয়টিকে স্বীকৃতি দিতে হবে।

১৩. সংগঠন ও কর্মপন্থা প্রতিষ্ঠা 

 রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এমনসব সংগঠন ও কর্মপন্থা প্রতিষ্ঠা করা উচিত যেগুলো সংশ্লিষ্ট সকল খাত, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে যোগাযোগ নীতি প্রণয়নের কাজে সক্ষম হবে। এজন্য যোগাযোগ নীতিমালা প্রণয়নের জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন লোক নিয়োগ করতে হবে ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য নির্ধারণ এবং যথার্থ মূলনীতি প্রনয়নের মাধ্যমে যোগাযোগ নীতিমালা একটি দেশের উন্নয়নে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রাখতে পারে।

বিশেষ করে কোন দেশের যোগাযোগ নীতি প্রণয়নে উপরোক্ত সাধারণ মূলনীতিগুলো মনে রাখতে হবে।

 এগুলো ছাড়া আরও মূলনীতি থাকতে পারে, তবে কোন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার পর উপরোক্ত সাধারণ মূলনীতিগুলো মনে রেখে যোগাযোগ নীতিমালা প্রণয়ন করলে তা ফলপ্রসূ হবে।

No comments

Powered by Blogger.