একবিংশ শতাব্দীর সাংবাদিকদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা । মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতা ।সিএজে একাডেমি

Marjan Akter

 একবিংশ শতাব্দীর সাংবাদিকদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা : মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতা  

গণমাধ্যমের সকল শাখায় মাল্টিমিডিয়া দক্ষতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ । তবে আধুনিক সাংবাদিকতার জগতে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে সাথে শুধু মাল্টিমিডিয়া ভিত্তিক গণমাধ্যম বা গণমাধ্যমে মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে ।

 মাল্টি  শব্দের অর্থ বহু আর মিডিয়া শব্দের অর্থ  মাধ্যম । অর্থ্যাৎ,  মাল্টিমিডিয়া শব্দের অর্থ বহুমাধ্যম । মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তির সাহায্যে লেখা,গ্রাফিক্স,অডিও,ভিডিও,সরাসরি সম্প্রচার সহ আরো বহুমাধ্যমে কাজ করতে পারে । মাল্টিমিডিয়া এমন একটি মাধ্যম যা একই সাথে বিভিন্ন ধরনের তথ্য ব্যবহারকারীর কাছে তুলে ধরতে পারে । পাঠক দর্শক ও শ্রোতাদের চাহিদার প্রেক্ষিতেই প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে সাংবাদিকতার ধরন । মানুষ একই সাথে দেখতে, পড়তে ও শুনতে চায় এবং সর্বশেষ তথ্য জানতে চায় ।যা একমাত্র মাল্টিমিডিয়ার দ্বারাই সম্ভব ।


বর্তমানে মাল্টিমিডিয়ার প্রভাব অনলাইন মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি । ২০০৮ সালে বিজ্ঞাপন হ্রাস হওয়ার কারণে লাভজনক অনেক মিডিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হয় । মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতায় যার ঝুঁকি কম । 

মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকতার নতুন অধ্যায় শুরু করে । করোনা ভাইরাসের মহামারীকালীন সময়ে অনেক মিডিয়া, প্রকাশনা ব্যবসায় গুটিয়ে নিয়েছেন অথবা তারা শুধু অনলাইন মাধ্যমে পরিণত হয়েছিলেন ।


সাংবাদিকতায় প্রয়োজনীয় দক্ষতা

 গত কয়েক বছর ধরে গণমাধ্যমগুলো নানাভাবে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে আসছে । লাভজনক বহু গণমাধ্যম বিজ্ঞাপনের অভাবে ব্যবসায় গুটিয়ে নিয়েছে । ২০০৮ সালে আন্তর্জিাতিক অর্থনৈতিক মন্দা যার অন্যতম কারণ । বাংলাদেশের মিডিয়া হাউস সমূহ বা পত্রিকার মালিকেরা সাংবাদিক বা কর্মী ছাটাঁই  করা শুরু করে । করোনা কালীন সময়েও অনেক প্রকাশক বা গণমাধ্যম শুধুই অনলাইনে সংবাদ প্রকাশ বা প্রচার করা শুরু করে । কোন কোন প্রতিষ্ঠান আবার দক্ষতার অভাবে তাও সম্ভব করে উঠতে পারে নি । কোন কোন  গণমাধ্যম কর্মী ছাঁটাই করে দেয় । 

 সাংবাদিকতা কখনোই সাধারণ চাকরির মতো ছিলো না । তাই সাংবাদিকতার মাধ্যমে যদি কেউ জীবিকা অর্জন করতে চায় তাকে অভিনব দক্ষতার অধিকারী হতে হবে । কারণ আধুনিক সাংবাদিকতা শুধু সংবাদ খোঁজার মধ্যে টিকে নেই । নাগরিক নিজেই সংবাদ খুঁজে নেয় বা পায় । সাংবাদিক হিসেবে আপনাকে সেই সংবাদ তথ্যকে আরো অভিনব ও সাজিয়ে উপস্থাপন করতে হবে ।

অর্থাৎ, একজন আধুনিক সাংবাদিককে তথ্য উৎপাদনের চেয়ে তথ্যকে প্রক্রিয়া করে ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করতে হবে । বর্তমানে তথ্য খুঁজে পাওয়া খুবই সহজ । তাই গণমাধ্যম সমূহ এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে চায় যে দ্রুত ও সুনিপুন সম্পাদনা করতে সক্ষম । 

বর্তমানে মানুষ সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের অংশ হিসেবে দক্ষ বিশেষজ্ঞ কর্মী চায় যারা নিজেদের গোপন মাধ্যমে মূল তথ্যকে উন্মোচন করে আনবে । যারা সত্য তথ্য প্রকাশ করবে এবং সেই তথ্যই প্রকাশ করবে যা সত্যই জনগণের প্রয়োজন । এমন সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীরা অবশ্যই সনাতন কর্মীদের চেয়ে ভালো বেতন বা সম্মানী পাবে ।




মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিকের প্রয়োজনীয় দক্ষতা  

১ . প্রিন্ট এবং অনলাইনের জন্য সাধারণ সংবাদের পাশাপাশি ফিচার কপি লিখে রাখা 

২. ম্যাগাজিন এবং ওয়েবসাইটের জন্য স্টোরি ভিজুয়ালাইজ 

৩ .ব্লগ লিখন 

৪. নিউজ এবং ফিচার কপি সহ-সম্পাদনা করা 

৫. সাক্ষাতকার নেয়া (অডিও ও ভিডিও )

৬. অডিও ভিডিও চিত্র ধারন ও সম্পাদনা 

৭. একটি কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার 

৮ . অনলাইন কিংবা সরাসরি মাধ্যমে সক্রিয় ব্যক্তি হয়ে ওঠা । 

৯. এসইও (SEO) এবং ট্যাগিং (Tagging) সংক্রান্ত জ্ঞান ও বাস্তবায়ন 

১০. অনলাইন নিউজ লেখার সময় নমনীয়তা অবলম্বন


১. প্রিন্ট এবং অনলাইনের নিউজের  পাশাপাশি ফিচার কপি : 

আধুনিক সাংবাদিককে একটি সংবাদের একই সাথে বিভিন্ন ধরন তৈরি করতে হবে । শুধুমাত্র গতানুগতিক সংবাদ লিখেই তিনি ক্ষান্ত হবেন না । পাঠক দর্শক শ্রোতা সংবাদের বিস্তারিত চায়বে বা খুঁজতে পারে এই ধরনায় সংবাদের বিস্তারিত ধরনা ও তথ্য প্রকাশ করবেন ।


২. স্টোরি ভিজুয়ালাইজ (গল্প দৃশ্যায়ন) : Story Visualization 

বিভিন্ন ধরনের গ্রাফ ,চার্ট,ম্যাপ, এনিমেশনের মাধ্যমে তথ্যকে তুলে ধরা ।ডাটা দৃশ্যায়ন বা গ্রাফিক্স এর মাধ্যমে আপনার স্টোরি অর্থবহ হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ প্রতিবেদনের তুলনায় মূল্য বৃদ্ধি পাবে । 

৩. ব্লগ লিখন : Blogging

 অনেকে মনে করে থাকে ব্লগিং এর আবির্ভাব সাংবাদিকতায় বা সংবাদ মাধ্যমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে । কিন্তু মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক হিসেবে ব্লগ লিখন একটি অন্যতম দক্ষতা । তাকে সংবাদ এবং ব্লগের মাঝে সমন্বয় করতে হবে । অবশ্যই ব্লগিং সাংবাদিকতা নয় । কিন্তু নতুন যুগের সাংবাদিক হিসেবে বিশাল পরিমাণ ব্লগ পাঠকদের তিনি উপেক্ষা করতে পারেন না ।

 

৪ .সহ সম্পাদনা  Subbing

একজন মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিককে ওয়ান ম্যান আর্মি হতে হবে । সনাতন ধারণা অনুসারে শুধু সংবাদ লিখে বা তৈরি করেই তার কাজ শেষ করা যাবে না । তিনি সম্পাদনার কাজটিও করবেন । প্রকৃতপক্ষে , বর্তমানে সংবাদ তৈরি এবং সম্পাদনা আলাদা আলাদা কোনো কাজ নয় । যিনি সংবাদ তৈরি করছেন সম্পাদনার  মূল কাজ তাকেই্ করতে হবে ।


৫. সাক্ষাতকার নেওয়া  Interview 

সঠিক তথ্য সংগ্রহ করার জন্য এক বা একাধিক ব্যক্তির সাক্ষাতকার আবশ্যক । তৈরিকৃত সংবাদটিকে সুষ্পষ্ট করতে সাক্ষাতকার আবশ্যক । স্বাস্থ্য ,অর্থনীতি ,রাজনীতি যে বিটই কাভার করা হোক সাক্ষাতকারের ভূমিকা অনস্বীকার্য । সাক্ষাতকার শুধু বিশেষজ্ঞ মতামত নয় এটি ক্ষতিগ্রস্থদের কন্ঠস্বর ও তুলে ধরে । তাই আধুনিক একজন সাংবাদিক সাক্ষাতকার নেওয়ার কৌশল সম্পর্কে অবগত থাকা প্রয়োজন । মনে রাখতে হবে , সাক্ষাতকার কেবল প্রশ্ন করা জবাব দেওয়া নয় । একজন ভালো সাংবাদিক হতে হলে সাক্ষাতকারকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে ।


৬. অডিও বা ভিডিও ধারন ও সম্পাদনা


বর্তমান পাঠকেরা শুধু টেক্সট দ্বারা তৃপ্ত হয় না । কোনো সংবাদ জানতে তথ্য পেলে সেটি সম্পর্কিত অডিও বা ভিডিও চিত্র অনুসন্ধান করে । তাই যে গণমাধ্যম বা ওয়েবসাইট ভিডিও ছবি অডিও সরবরাহ করতে পারে দর্শক সেদিকেই ছুটে । তাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাংবাদিক হিসেবে এ সম্পর্কিত জ্ঞান না থাকলে আপনি তালিকার শেষে অবস্থান করবেন । অডিও ভিডিও ধারনের পাশাপাশি এগুলো সম্পাদনা দক্ষতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । তাৎক্ষণিক বা সবার আগে সর্বশেষ প্রকাশের জন্য হলেও সাংবাদিক হিসেবে অডিও ভিডিও সম্পাদনা কৌশল সম্পর্কে অবগত হতে হবে


৭ . সিএমএস বা কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ( CMS)

Content Management System (CMS)  কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম হলো একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম যার মাধ্যমে একটি ওয়েবসাইটের বিভিন্ন কন্টেন্ট (লেখা ছবি অডিও ভিডিও) সম্পাদনা ,প্রকাশ, পরিবর্তন করা হয় । ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য সিএমএস তৈরি করা হয় । ১৯৯০ সালে প্রথম সিএমএস ধরনা প্রকাশিত হয় । জনপ্রিয় কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এর নাম -ওয়ার্ডপ্রেস ,জুমলা,মডএক্স,ম্যাজেন্টা,দ্রুপাল ইত্যাদি ।একজন সাংবাদিক তার তথ্যকে অনলাইন জগতে বিস্তৃত করে দিতে সিএমএস জ্ঞান রাখবেন । বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বা পত্রিকা তাদের ওয়েবসাইটে প্রতিদিনের তথ্য বা খবর প্রকাশ করার জন্য ফ্রিল্যান্সার নিয়োগ করে থাকেন । তাই নিজের তৈরি করা সংবাদ সাংবাদিক নিজেই ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখেন  তবে তার মূল্য অন্যান্যদের তুলানায় অনেক বেড়ে যায় ।


৮. সক্রিয় থাকা 

সবার চেয়ে আলাদা হতে হলে প্রথম কাজ হলো সবচেয়ে সক্রিয় থাকা । অনলাইন কিংবা অফলাইনে নিয়মিত কাজ করে যাওয়া । প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে সময় দেয়া ব্যক্তিকেই যে কোনো স্থানে প্রাধাণ্য দেয়া হয় । যাকে জোর প্রদান করে কিংবা বার বার প্রনোদিত করতে হয় এমন ব্যক্তিরা চাকরি জগতেই নগণ্য , সাংবাদিকতায় তাদের টিকে থাকার প্রশ্নই আসে না ।

৯ .এসইও এবং ট্যাগিং : SEO and Tagging 

SEO : ওয়েবসাইট এবং বিভিন্ন মাধ্যমে নিজের প্রকাশিত সংবাদকে বিস্তৃত বা সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে এসইও এবং ট্যাগিং এর ধারনা থাকা প্রয়োজন । এসইও হলো অনুসন্ধান ইঞ্জিনের ফলাফলের পৃষ্ঠাগুলিতে দৃশ্যমানতা বাড়ানোর জন্য আপনার ওয়েবসাইটটিকে অনুকূলকরনের প্রক্রিয়া । এসইও এর লক্ষ্য হলো একটি অনুসন্ধানের সময়ে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে ট্রাফিকের পরিমাণ এবং গুণগত মান বাড়ানো । নিজের লেখা কোনো আর্টিকেল যদি অনুসন্ধানের প্রথম পৃষ্ঠা বা প্রথম সারিতে রাখতে চান তবে এসইও আপনাকে সাহায্য করবে । এসইও একটি গতিশীল ক্ষেত্র যা আপনাকে ইন্টারনেট সম্টর্কে শিখতে সাহায্য করবে । আর তাই মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক হিসেবে এসইও ধারনা থাকা প্রয়োজন ।


 Tagging ট্যাগিং হলো প্রাকাশিত আর্টিকেল বা কন্টেন্ট সম্পর্কিত শব্দগুচ্ছ বা কিওয়ার্ড বরাদ্দ করে দেয়া । সাংবাদিককে কন্টেন্ট রিলেটেড ট্যাগিং করার সময় সঠিক শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করতে হবে ।


১০. নমনীয়তা অনলাইনের ক্ষেত্রে

  প্রিন্ট মিডিয়াতে প্রকাশ করার পর সম্পাদনা করার সুযোগ নেই । অনলাইনে যেহেতু সম্পাদনা করার সুযোগ আছে তাই কোনো ভুল হলে দ্রুত তা সংশোধন করার দক্ষতা থাকতে হবে । প্রথম আলোর কালো তবুও সুন্দর বিতর্কের পর অনলাইন মাধ্যমে সম্পাদনা করে দেয়


লেখক : শিক্ষার্থী , ৪র্থ বর্ষ

যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ , চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


No comments

Powered by Blogger.