বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ । জনবক্তৃতা হিসেবে একটি বিশ্লেষণ

 Marjan Akter 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ : জনবক্তৃতা হিসেবে একটি বিশ্লেষণ 

। প্রায় ২৩ বছরের শোষণ ও অত্যাচার যখন চুড়ান্তে পৌঁছে গিয়েছিল , ছোট খাটো বিচ্ছিন্ন আন্দোলন যখন পশ্চিম পাকিস্থানের শোষকদের দমানো যাচ্ছিলো না । তখনই সারা জাতিকে একত্র করার জন্য বলিষ্ঠ কোনো আহবানের অতীব প্রয়োজন ছিল । ঠিক তখনই জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এমন একটি ভাষণ দিয়েছিলেন যাতে ইতিহাস , রাজনৈতিক বক্তব্য , আদেশ ,নিষেধ উৎসাহ প্রেরণা দেশপ্রেম ও সর্বোপরি যুদ্ধের জন্য সাহস সঞ্চার করেছিলেন । এটি শুধু একটি ভাষণ বা যুদ্ধের  আহবান নয় জনবক্তৃতার একটি আদর্শ উদাহারণ এটি ।

 একটি উৎকৃষ্ট বক্তৃতার জন্য দক্ষ ও সাবলীল বাগ্মিতা , ভাষার ব্যবহার, দর্শক বা শ্রোতার হৃদয়কে আকর্ষণ করা ও স্বরের ব্যবহারের সমাবেশ প্রয়োজন । আর এইসব উপাদানের ব্যবহারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল অন্যতম ।


একটি জনবক্তৃতাকে বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে জোসেফ এ ডেভিটো কয়েকটি বিষয়ের কথা বলেছেন - 

১. বক্তব্যের বিষয় ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ

২. দর্শক-শ্রোতা-পাঠক বিশ্লেষণ 

৩. বক্তব্য উপস্থাপন করার দক্ষতা ও কৌশল


১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু বলীয়ান কণ্ঠে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটিতে জনবক্তৃতার উপাদান বা বিষয়গুলো বেশ সুচারুরূপে প্রকাশ পেয়েছে । ১৯ মিনিটের এই কালজয়ী ভাষণের প্রতি মিনিটে ৫৮ থেকে ৬০ টি শব্দ উচ্চারণ করা হয়েছিল । আধুনিক অনেক যোগাযোগবিদ এ বক্তব্যটিকে বিশ্লেষণ করেছেন । জোসেফ এ ডেভিটো এর দেয়া জনবক্তৃতার বিশ্লেষণের বিষয়গুলো অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কিভাবে ফুটে উঠেছে তা আলোচনা করে দেখা যাক ।

১. বক্তব্যের বিষয় ও উদ্দেশ্য নির্ধারন :

 এই ভাষণের উদ্দেশ্য ছিল মূলত পশ্চিম পাকিস্থানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহবান । ১৯৭০ এর জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পশ্চিম পাকিস্থানী রাজনীতিবিদরা পূর্ব পাকিস্থানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায় নি । নানা ছল করে পূর্ব পাকিস্থানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যহত করছিল পশ্চিম পাকিস্থান। যার ফলে পূর্ব পাকিস্থানের  জনগণ বিক্ষোভ ও হরতাল পালন করে । যার অংশ হিসেবে ৭ই মার্চের ভাষণের আয়োজন করা হয় । এই ভাষণে সামগ্রিক পরিস্থিতির আলোচনা পশ্চিম পাকিস্থানী রাজনৈতিকদের কার্যক্রম , সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি , অত্যাচার শোষণের ইতিহাস আলোচনা ও মোকাবেলার জন্য আহবান ও দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন ও হরতাল চালিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে ।



২. দর্শক শ্রোতা পাঠক বিশ্লেষণ :

 মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় ও স্বাধীনতার মূলমন্ত্র হিসেবে এই্ ভাষণ ছিল অন্যতম উৎস । এই ভাষণে সরাসরি প্রায় ১০ লাখ মানুষের উপস্থিতি ছিল এমন জনশ্রুতি রয়েছে । ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে শিশু-কিশোর ,যুবক-বৃদ্ধ -তরুণ সকল বয়সের সকল পেশার মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল । কোনো নির্দিষ্ট বয়স বা পেশার মানুষের জন্য আবদ্ধ ছিল না এই ভাষণ । সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে যু্দ্ধের আহবান ছিল এটি । শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক উপস্থিতি জনগনের জন্য নয় ভাষণটি এখনো বাঙালির প্রেরনার উৎস । ভাষণটি তৎকালীন রেডিও টেলিভিশনে প্রচার করার অনুমতি না পেলেও পাকিস্থান সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক ও অভিনেতা আবুল খায়ের ভাষণের ভিডিও ধারন করেন এবং প্রযুক্তিবিদ এইচ এন খোন্দকার ভাষণের অডিও রেকর্ড করেন । এই ভাষণ দর্শক ও পাঠকের মাঝে বেশ উদ্দীপনার সৃষ্টি করে । 

তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ো । ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলো । এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম । এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ।

 


ইত্যাদি শ্লোগান বেশ সাড়া ফেলে ।


৩. বক্তৃতা প্রদানের দক্ষতা ও কৌশল :

 রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং যুদ্ধের আহবানে ভাষা,স্বর ও অঙ্গভঙ্গির প্রয়োগে এই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর দক্ষতা লক্ষনীয় । শ্রোতাকে আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সুন্দর বাচনশৈলী রক্ষা করেছেন । তিনি নিজেকে নেতা নয় দর্শকদের কাতারের একজন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন । ”ভাইয়েরা আমার” , সম্মোধন করে তিনি উপস্থিত দর্শকদের একজন হয়ে উঠেছিলেন । শুধু তথ্য প্রদান নয় তিনি আদেশ ,নিষেধ, অনুরোধ এবং অধিকারের কথা বলেছেন। দর্শকদের কাছে নানা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন । যার ফলে তার সাথে সার্বক্ষনিক দর্শকের সাথে যোগাযোগ হচ্ছিল ।


এই বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর শারীরিক অঙ্গভঙ্গি ,হাতের নাড়াচাড়া আঙ্গুল তুলে কথা বলা এবং দৃষ্টি বিনিময় ছিল আরেকটি অন্যতম বিষয় । যা বক্তৃতাটিতে প্রাণের সঞ্চার করেছিল । সম্পূর্ণ বক্তৃতায় তিনি বিদ্রোহীর মতো রণমূর্তি ধারন করে বজ্রের মতো একেকটি বাক্য উপস্থাপন করেছেন । বক্তৃতার সময় তিনি জনগনের সামনে স্টেজে অবস্থান করেছিলেন । একটি স্থানেই দাঁড়িয়ে তিনি বক্তব্য দিয়েছিলেন । এই বক্তব্যটিতে কোনো প্রকার রসাত্মক কথার উপস্থিতি ছিল না । বক্তৃতায় ভাষার দক্ষতা বা কৌশল বেশ জোরালো ছিল তবে কোনো প্রকার ডিজিটাল স্লাইড, গ্রাফ বা ছক উপস্থাপন করা হয় নি ।


সর্বোপরি বলা যায়, এই ভাষণটি জন বক্তৃতার এক অন্যতম উদাহরণ । পরবর্তীতে এ ভাষণের ব্যাপক বিশ্লেষণ , আলোচনা অনুবাদ হয়েছে । ইউনেস্কো ২০১৭ সালে এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয় । এই ভাষণ বাঙালির এক অনন্য ঐতিহ্যও বলা চলে

লেখক : শিক্ষার্থী , ৪র্থ বর্ষ

যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.