শেইনের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি মডেল । Schein's Organizational Culture Model
এজগার শেইনের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি মডেল
এজগার শেইন
এজগার শেইন একজন ব্যবস্থাপনা স্কলার ও পরামর্শদাতা যিনি সাংগঠনিক সংস্কৃতির বিকাশ ও পরিচালনায় নেতাদের ভূমিকা নিয়ে কাজ করেছেন । সংগঠন পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় সংস্কৃতি কিভাবে প্রভাব ফেলে তা নিয়ে গবেষণা করেছেন শেইন । এজগার হেনরি শেইন ১৯২৪ সালের ৫ই মার্চ জুরিখে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি MIT Sloan school of Management এর সাবেক প্রেফেসর হিসেবে সাংগঠনিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করেছেন । কর্মজীবনে উন্নয়ন (ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট ) সাংগঠনিক সংস্কৃতি ও গ্রুপ প্রক্রিয়া আলোচনা সহ সংগঠনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন । ১৯৯২ সালে সংস্কৃতির মডেল বর্ণনা করে Organizational Culture and Leadership নামে একটি বই রচনা করেন ।
সংস্কৃতির সংজ্ঞা শেইনের মতে :
শেইন নিম্নোক্তভাবে সংগঠন ও অন্যান্য গ্রুপ বা দলের (প্রতিষ্ঠান) সামাজিক আচরণের ভিত্তিতে এটি বর্ণনা করেছেন । শেইন এর মতে সংস্কৃতি চার ধরনের -
১. ম্যাক্রো কালচার
২. সাংগঠনিক কালচার
৩. উপ কালচার
৪. মাইক্রো কালচার
সাংগঠনিক সংস্কৃতি শব্দটি একটি প্রতিষ্ঠানের মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসকে বোঝায় । নীতি, মতাদর্শের পাশাপাশি একটি সংস্থার দ্বারা অনুসরণ করা নীতিগুলো তার সংস্কৃতি গঠন করে । কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিরা একে অপরের সাথে কীভাবে যোগাযোগ করবে এবং কোম্পানির লোকদের সাথে কিভাবে আচরণ করবে সেই সম্পর্কিত আলোচনাই কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতি ।
কর্মীদের অবশ্যই তাদের প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতিকে সম্মান করতে হবে যাতে তারা তাদের সর্বোত্তম ভাবে সংগঠনকে সাহায্য করতে পারে । কিন্তু নতুন কর্ম সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য করতে কর্মীরা অক্ষম হয় এবং কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করে ।
এজগার শেইনের সংগঠন সংস্কৃতির মডেল :
এজগার শেইনের এই মডেলটি প্রায় ৩ দশক পুরোনো হলেও সংগঠনের সংস্কৃতির আলোচনায় এখনো এটি মেনে চলা হয় । শেইনের মতে সংগঠনের সর্বত্রই সংস্কৃতি । কর্মীরা কীভাবে কাজ করে , তাদের মূল্যবোধ ,নিয়ম ও নীতিই সংগঠনের সংস্কৃতি । তাই শেইন মনে করেন , সংগঠনের সংস্কৃতি সংগঠনের পরিচয় তুলে ধরে । সংগঠনগুলো একদিনে সংস্কৃতি গ্রহণ করে না , বরং কর্মচারীরা বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায় । বাহ্যিক পরিবেশের সাথে খাপ খায় এবং সমস্যার সমাধান করে । শেইন মনে করেন সংগঠনের সংস্কৃতির তিনটি স্তর রয়েছে । যথা -
১. শিল্পকর্ম ও আচরণ
২. মূল্যবোধ
৩. অনুমান
স্তর ১ শিল্পকর্ম ও আচরণ :
শেইনের এই মডেলের প্রথম ধাপ হলো নিদর্শন বা শিল্পকর্ম । এই স্তরে কর্মীদের আরচণও বিদ্যমান । এই স্তর হলো সাধারণত কর্মীদের বা সংস্থার এমন বৈশিষ্ট্য যা দেখা যায় ,শোনা যায় এবং অনুভব করা যায় । প্রতিষ্ঠানের দালান , সাজসজ্জা ,কর্মীদের পোশাক, অফিসের আসবাবপত্র,কর্মচারীদের আচরণ, সংগঠনের লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি সবই এই স্তরের অধীনে । এইসব উপাদানসূহ একটি প্রতিষ্ঠানের আবশ্যক উপাদান । প্রতিষ্ঠানের সাজসজ্জা কিংবা দেয়ালও প্রতিষ্ঠানের কথা বলে । কর্মীদের সম্পর্ক , আচরণ ও পোশাক তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানের ধরন । আগে দর্শনধারী পরে গুণ বিচারি বর্তমানে বেশ প্রচলিত । আর ‘দর্শনধারী’ বিষয়টি এই স্তরেই প্রতিফলিত হয় । প্রতিষ্ঠানে কোনো গবেষক বা নতুন ব্যক্তির আগমন হলে আগে বাহ্যিক জিনিস ও আচরণই লক্ষ্য করে থাকেন ।
তবে শেইনের মতে, এ স্তরটি ব্যাখ্যা করা কঠিন । অর্থ্যাৎ, হঠাৎ করে আপনি যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখতে পান যে প্রত্যেক ব্যক্তি একে অপরকে পেশাভিত্তিক নামে ডাকছে যেমন- প্রফেসর গেলাম রহমান ,ডক্টর আজগর, ইত্যাদি । তাহলে আপনি বিষয়টিকে কীভাবে নেবেন ? হয়তো তাদের মাঝে ঘনিষ্ঠতা থাকা সত্বেও পেশার মর্যাদার ভিত্তিতে ডেকে থাকেন । কিন্তু আপনি ভেবে নিলেন তাদের মাঝে কোনো বন্ধুত্ব নেই । আর তাই প্রথম স্তরকে যথাযথভাবে বুঝতে হলে ২য় স্তরে আসতে হবে ।
স্তর ২ সমর্থিত মূল্যবোধ :
এ স্তরে সাধারণত কর্মীদের ও প্রতিষ্ঠানের মূল্যবোধ , আচরণ , নিয়মাবলী ইত্যাদি থাকে । সাংগঠনিক সংস্কৃতির এই স্তরের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি উপাদান নিম্নরূপ :
১ মূল্যবোধ বা প্রতিষ্ঠান মেনে চলা ।
২. নিযম নীতি
৩. ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের আদেশ নিষেধ
৪. প্রকাশিত নিয়ম বা কর্মচারীদের মানতে হয়
৫. প্রচারপত্র বা ইশতেহার
৬. ওয়েবসাইট
কর্মীদের মূল্যবোধ সংগঠন সংস্কৃতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে । কর্মচারীদের চিন্তা প্রক্রিয়া এবং মনোভাব যেকোন বিশেষ সংস্থার উপর গভীর প্রভাব ফেলে । তবে প্রতিষ্ঠানের সব নিয়ম রীতি সমানভাবে প্রভাব ফেলে না । প্রতিষ্ঠানের নেতাদের প্রয়োজনীয় নিয়ম নীতির প্রণয়ন করতে হবে । যা প্রতিষ্ঠোনের জন্য সবচেয়ে ভালো প্রভাব ফেলবে ।
সকলের আলাদা আলাদা মূল্যবোধ রয়েছে তবুও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে কিছু সমর্থিত মূল্যবোধ এই স্তরে মেনে চলা হয় । আবার সমর্থিত মূল্যবোধের বদলে ব্যবস্থাপকরা নিজ মূল্যবোধও মেনে চলে , যা এ স্তরের বৈশিষ্ট্যকে অমান্য করে । যেমন - একজন নেতা বলে থাকেন তিনি কর্মীদের থেকে মতামত আশা করেন । আবার সেই একই নেতা কারো মতামত না শুনে নিজের মতকেই প্রধান্য দেন । আবার স্তর ১ এবং স্তর ২ এর মাঝে পার্থক্য থাকতে পারে । যেমন- কোন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট বেশ ধনাঢ্য কিন্তু বাস্তবিক সাজসজ্জা বা কর্মীদের আরচরণ খুবই অগোছালো । আর তাই সম্পূর্ণ বুঝতে হলে ৩য় স্তরে যেতে হবে ।
স্তর ৩ : অনুমিত মূল্যবোধ :
এই স্তর সংগঠনের সংস্কৃতির মূল শক্তি । এই স্তর পরিবর্তন করা কষ্টসাধ্য । কর্মচারীদের অনুমিত মূল্যবোধ বা প্রতিষ্ঠানের অনুমিত নিয়মনীতি,রুটিন যা পরিমাপ করা যায় না, দেখা যায় না কিন্তু সংস্কৃতি তে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে । এই স্তরে সাধারণত প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাস ,সত্য বা গোপন কৌশল যা সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে ।
সংস্থাসমূহ প্রায় আলোচনা করে না কিন্তু নিজেরা ঠিকই বোঝে এমন বিষয় সমূহ এই স্তর গঠন করে । যেমন - মানুষের প্রকৃতি,বিমূর্ত ধারনা , সম্পর্ক । মানব প্রকৃতির অভ্যন্তরীণ দিকগুলো এ স্তরের অধীনে আসে ।
তিন স্তরের সহ- সম্বন্ধ :
শেইনের মডেলের ৩ টি স্তর এক অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত । একটি স্তরের পর আরেকটি স্তরে ধাবিত হয় । একটি স্তরের সমস্যাগুলো বা বুঝতে সমস্যা হলে পরের স্তরে যাওয়া যায়। তিনটির মাঝে মিল থাকা প্রয়োজন । না হলে প্রতিষ্ঠানে আসা পরিদর্শকরা তৃপ্ত হবেন না । বাহ্যিক নিদর্শন ও আচরণের অনুসরনে কিছু মূল্যবোধ সমর্থন করে যা প্রকৃত রুপে বুঝতে হলে অনুমিত মূল্যবোধ বোঝা প্রয়োজন ।
লেখক : শিক্ষার্থী ,৪র্থ বর্ষ
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments