মনোভাব কী । মনোভাবের উপাদান । মনোভাব গঠন ও পরিবর্তন
মনোভাব কী । মনোভাবের উপাদান । মনোভাব গঠন ও পরিবর্তন
মনোভাব কী
মানুষ সামাজিক জীব ।সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা তাঁর সহজাত প্রবণতা। সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ের সাথে যে জড়িত সমাজে বসবাস করতে গিয়ে একটা মানুষের মধ্যে চেতনার জাগরণ হয়। ধনাত্মক ও ঋণাত্মক দুই ধরনের চেতনা রয়েছে। ধরা যাক , কেউ বাংলা শিক্ষক কে পছন্দ করে, তার মানে ওই শিক্ষকের প্রতি তার ধনাত্মক প্রবণতা রয়েছে । অন্যদিকে সে গণিত শিক্ষক কে পছন্দ করে না, তার মানে ওই শিক্ষকের প্রতি
ছাত্রের ঋণাত্মক প্রবণতা রয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানী থাস্টোন মনে করেন যে, মনোভাব হচ্ছে কোন একটি মানসিক বিষয় বস্তুর প্রতি ব্যক্তির ধনাত্মক বা ঋনাত্মক অনুভূতি মাত্র । মনোভাব ব্যক্তির একটি অপেক্ষাকৃত ধীরস্থির মানসিক প্রবণতা। কোন বস্তু পরিবেশ এবং ব্যক্তি বিশেষের প্রতি অনুকূল বা প্রতিকূল সম্ভাবনাকে মনোভাব বলা যেতে পারে। নিম্নে মনোভাবের কয়েকটি সংজ্ঞা দেওয়া হল –
জি ডব্লিউ আলপোর্ট বলেন ,মনোভাব মানসিক ও স্নায়ুবিক প্রস্তুতি স্বরূপ , যা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সংঘটিত হয় এবং ব্যক্তির পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও বস্তুর সাথে তার প্রতিক্রিয়ায় উপর নির্দেশক ও গতিশীল প্রভাব বিস্তার করে।
মারফি, মারফি ও নিউকসর বলেন, কোন বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে যাবার পূর্বপ্রস্তুতি কে মনোভাব বলে।
ডি জে বেম বলেন, ব্যক্তিবিশেষ বস্তু ধারণাসমূহ বা ঘটনাবলী সম্পর্কে ধনাত্মক বা ঋনাত্মক মূল্যায়ন মনোভাব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে।
মনোভাবের উপাদান
মনোভাবের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে তিনটি মৌলিক উপাদান পাওয়া যায় :
ক . জ্ঞানজ উপাদান
খ. অনুভূতি উপাদান
গ . ব্যবহার সম্বন্ধীয় উপাদান।
ক . জ্ঞানজ উপাদান
কোন বিষয়ের প্রতি ব্যক্তির বিশ্বাস হচ্ছে তার মনোভাবের জ্ঞানজ উপাদান। একটি উদাহরণের সাহায্যে বুঝা যাক – কোন একটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক মনোভাব আছে । ঐ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অবহিতমূলক বিশ্বাস হলো-
: প্রতিষ্ঠানের সুনাম, ছাত্রছাত্রীদের কৃতিত্ব, পরীক্ষায় ভালো ফলাফল, কয়েকশ বছরের ঐতিহ্য ইত্যাদি।
খ . অনুভূতি উপাদান
কোন বিষয় বস্তুর প্রতি ব্যক্তির মনোভাব জনিত বিশ্বাস যাকে আমরা জ্ঞানজ উপাদান বলি তা একটি অনুভুতির সৃষ্টি করে এটাকেই অনুভূতি উপাদান বলে। ধরা যাক , ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ছাত্র-ছাত্রীর ইতিবাচক মনোভাব। অর্থাৎ, তারা ওই প্রতিষ্ঠানকে পছন্দ করে।
গ . ব্যবহার সম্বন্ধীয় উপাদান
কোন বস্তু বা বিষয়ের প্রতি ব্যক্তির মনোভাব থাকলে তা সে ধনাত্মক বা ঋণাত্মক হোক না কেন ব্যক্তির মধ্যে অনুভূতিমূলক অবস্থা বিরাজ করে এবং তা একটি মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি তৈরি করে। এই প্রস্তুতি দ্বারা ব্যক্তি ও বিষয়বস্তু বা বিষয়ের প্রতি আচরণ ও প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়। একটি উদাহরণ দ্বারা বলা যায়-
কোন ব্যক্তির ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করলে শিক্ষার্থীরা তা খন্ডন করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে এবং প্রতিষ্ঠানের ভালো দিকগুলো তুলে ধরে এটাই হলো মনোভাবের আচরণগত দিক।
মনোবিজ্ঞানের আরো আর্টিকেল পড়ুন
মনোভাব গঠন
মনোভাব আচরণ সৃষ্টিকারী এক ধরনের পূর্ব প্রস্তুতি এবং এটা জন্মগত নয়। এটা অবশ্যই অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া এবং বিষয়লব্ধ একটি বিষয়। মনোভাব পরিবার থেকে ,সমাজ থেকে ,ব্যক্তির শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জিত হয় ।এক্ষেত্রে সাপেক্ষীকরণ, করণ শিক্ষণ, অনুকরণ ইত্যাদি প্রক্রিয়াগুলো কাজ করে। এখন আমরা দেখব কিভাবে এই মনোভাব গঠিত হয় । নিচে মনোভাব গঠন গুলো আলোচনা করা হলো
১.চিরায়ত সাপেক্ষীকরণ :
রাশিয়ান শারীরবিজ্ঞানী প্যাভলব সাপেক্ষীকরণ এর উপর সর্বপ্রথম পরীক্ষণ পরিচালনা করেন। এখানে বলা হয়েছে, একটি উদ্দীপকে যদি মনোভাব সৃষ্টিকারী কোন ঘটনার সাথে যুগপতভাবে কয়েকবার উপস্থাপন করা হয় তাহলে ঐ উদ্দীপকটি পরবর্তী সময়ে উল্লেখিত মনোভাব উদ্বেগ করবে ।লোর এবং স্টার্টস প্যাভলবের সূত্র অনুযায়ী, জাপানি , কোরীয় এবং ক্যানটানি ভাষাভাষীদের উপর গবেষণা কর্ম পরিচালনা করেন ।তারা প্রত্যেক পরীক্ষণ পাত্রের সামনে একটি বিশেষ অর্থহীন এবং ইতিবাচক অর্থপূর্ণ শব্দ একসাথে উপস্থাপন করেন। গবেষণায় দেখা যায় যে ,পরীক্ষণ পাত্ররা তিন ধরনের ভাষার ক্ষেত্রে ইতিবাচক শব্দের সাথে উপস্থাপিত অর্থহীন শব্দসমূহ প্রীতিকর হিসেবে মূল্যায়ন করেছে।
২. সহায়ক শিক্ষণ:
সহায়ক শিক্ষণ প্রক্রিয়া মনোভাব গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে । শিক্ষণের প্রধান শর্ত হলো সন্তুষ্টি অর্জন ।এ শিক্ষণে প্রাণী পুরস্কার প্রাপ্তির আশায় তার মনোভাব পরিবর্তন করে। যেমন : শিশুকে যদি বলা হয় সত্য কথা বললে তাকে পুরস্কৃত করা হবে এবং মিথ্যা কথা বললে তাকে শাস্তি পেতে হবে ।এর ফলে দেখা যাবে যে শিশু সত্য কথার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব এবং মিথ্যা বলার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হবে।
৩. অনুকরণ :
মনোভাব গঠনে আরেকটি প্রক্রিয়া হল অনুকরণ ।শিশু তার পিতা-মাতা, ভাই-বোন, শিক্ষকদের ব্যক্ত মনোভাবের অনুকরণে অনুরূপ মনোভাব অর্জন করে। সাধারণ ছেলেরা পিতার মনোভাবকে এবং মেয়েরা তার মায়ের মনোভাবকে অনুকরণ করে থাকে।
আলবার্ট ব্যান্ডুরা সামাজিক শিক্ষণের অন্যতম প্রবক্তা ।তাঁর মতে ,আদর্শ প্রতীকের আচরণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মনোভাবের শিক্ষণ ঘটে। পিতা-মাতা ,ভাই-বোন ,শিক্ষক শিশুর আদর্শ প্রতীক রূপে গণ্য হন বলে তাদের আচরণ শিশুরা অনুকরণ করে মনোভাব গঠন করে।
মনোভাব গঠনের উপাদান সমূহ ব্যক্তির মনোভাব বিভিন্ন উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে । নিম্নে মনোভাব গঠনের কয়েকটি উপাদান আলোচিত করা হলো-
i. চাহিদা পূরণ
ব্যক্তির চাহিদা পূরণ এবং চাহিদা অনুযায়ী দ্রব্যসামগ্রী বাবার মধ্যে পাবার মধ্যে একটা সম্পর্ক থাকে। যে সমস্ত বিষয়াদি ব্যক্তির চাহিদা পূরণে সহায়ক সেসব বিষয়াদির প্রতি ব্যক্তির অনুকূল মনোভাব সৃষ্টি হয়। অপরপক্ষে যে সমস্ত শক্তির চাহিদা পূরণে বাধা প্রদান করে সেসব শর্তের প্রতি ব্যক্তির প্রতিকূল মনোভাব সৃষ্টি হয়।
ii.সামাজিক প্রভাব
সামাজিক প্রভাব সৃষ্টিকারী শর্ত দ্বারা মনোভাব সংগঠিত হয়। একজন শিশুর মনোভাব প্রথমে তার পিতামাতার মতামত এবং পরে খেলার সাথী দ্বারা প্রভাবিত হয়।
iii.তথ্য পরিবেশন
তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে পিতা-মাতা-সন্তান মনোভাব গঠনে সাহায্য করতে পারেন । তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ব্যক্তিবিশেষ, বস্তু ,রাজনীতি ,আদর্শ, নীতি এবং পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনাবলি সম্বন্ধে মনোভাব সৃষ্টি করা যায় ।
ix.পুরস্কার ও শাস্তি
কোন একটি ভালো কাজ করার পর পিতা-মাতা শিশুকে প্রশংসা করেন এবং ভুল আচরণের জন্য শাস্তি দিতে পারেন।
x. একাত্মীভাবন
শিশুরা যখন বড় হতে থাকে তখন তারা যেসব লোকদের পছন্দ করে সে সব লোকদের সমকক্ষ হতে চায়। এটি একটি শিক্ষণ প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি অন্যের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী কে নিজের বৈশিষ্ট্য বলে মনে করে ।
xi.সভা-সমিতি
প্রত্যেক সদস্য সভা-সমিতির রীতিনীতি নিয়মকানুন এগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। ধীরে ধীরে সমিতির অন্যান্য সদস্যদের সাথে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব স্থাপন করতে সক্ষম হয় ।
xii.ব্যক্তিত্ব
একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব যেমন কৃষ্টি ,শিক্ষা, বুদ্ধি, রাজনৈতিক ধারণা প্রভৃতি উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে ।অনুরূপভাবে এসব উপাদান ব্যক্তির
মনোভাব গঠনে সাহায্য করে।
মনোভাব পরিবর্তন
ব্যক্তির মনোভাব যেভাবে গঠিত হয় ঠিক একইভাবে তা পরিবর্তিত হতে পারে। মনোভাব পরিবর্তন বলতে বুঝায় ব্যক্তির বর্তমান মনোভাবকে পরিবর্তন করে নতুন ধারণা সৃষ্টি করা। মনোভাব পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তির আচরণের মধ্যে পরিবর্তন আনা সম্ভব। এ অবস্থায় ব্যক্তির মধ্যে বিরাজমান বিভিন্ন ধারণা ,দর্শন, মূল্যবোধ, বিশ্বাস ,চিন্তা ভাবনা এগুলো পরিবর্তন করে নতুন ধারণা সৃষ্টি করা।
নিম্নে মনোভাব পরিবর্তন এর কয়েকটি মাধ্যম আলোচনা করা হলো-
১. নতুন তথ্য পরিবেশন
তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে ব্যক্তির মনোভাব সহজেই পরিবর্তন করা যায়। মিতনিক ও ম্যাকগিনিজ এর পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে ,তথ্য পরিবেশনের সময় কোন একটি দল যদি সে তথ্য সমালোচনা করে তাহলে এর ক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে ।গবেষক দল গোষ্ঠী সহনশীলতার উপর ভিত্তি করে একটি ছবি তৈরি করেন এবং ছবিটি দু’দল স্কুল শিক্ষার্থীর উপর দেখানো হয় যেসব শিক্ষার্থী বেশি সংস্কারমনা ছিল তাদেরকে এককভাবে ছবি দেখতে দেওয়ার ফলে তাদের মনোভাবের অনেক পরিবর্তন ঘটে। অন্যদিকে যারা কম সংস্কারমনা ছিল তাদেরকে ছবি দেখানোর সময় সমালোচনা সুযোগ দেওয়ার ফলে দ্বিতীয় দলের মনোভাবের পরিবর্তন হয়নি ।আবার মনোভাব পরিবর্তনের জন্য তথ্য প্রেরকের বৈশিষ্ট্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত একটি তথ্যের প্রতি আমাদের অনুকূল মনোভাব সৃষ্টি হয়।
২. অন্যের ইচ্ছে মেনে নেওয়া
অন্যের ইচ্ছে মেনে নেওয়ার মাধ্যমে মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে অনেক সময় একজন ব্যক্তিকে অন্যান্য ব্যক্তির অনুরোধ মেনে চলতে হয়। এরূপ অনুরোধ মনোভাব পরিবর্তনে সাহায্য করে। যেমন – অনেক সময় আমরা কর্তৃপক্ষের আদেশ নিষেধ মেনে চলতে বাধ্য হই ।
৩. ভারসাম্য মতবাদ
ভারসাম্য মতবাদের মূল বক্তব্য হলো মানুষ তার অবহিতির কাঠামোর মধ্যে একটি ভারসাম্য আনয়ন করে এবং সেই কাঠামোর মধ্যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয় তখনই মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। অবহিতি ভারসাম্য মতবাদ সমূহের মধ্যে অপেক্ষাকৃত পুরাতন ও অন্যতম হলো হাইডার এবং নিকমব্ এর মতবাদ ।হাইডার এর মতে , অবহিত ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় উপাদান সুসামঞ্জস্য থাকে। এ অবস্থায় ব্যক্তির মধ্যে মানসিক চাপ থাকে না। ভারসাম্যের অভাব হলে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। তখনই মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে। হাইডার কতগুলো প্রতীক ব্যবহার করে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা ও ভারসাম্যহীন
অবস্থাকে উপস্থাপন করেছেন।
৪.অবহিতিমূলক সামঞ্জস্যহীনতা মতবাদ
মনোভাব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ফেষ্টিঞ্জারের মতবাদটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ । এর মূল বক্তব্য হলো মানুষ অবহিতিমূলক উপাদানের মধ্যে সঙ্গতি রক্ষা করতে চায়। যদি বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে অসঙ্গতি দেখা যায় তাহলে ব্যক্তির মধ্যে মানসিক চাপ ও অশ্বস্তি বোধ দেখা যাবে।
No comments