যোগাযোগ শঙ্কা কী । যোগাযোগ শঙ্কার প্রকারভেদ

তাসলিমা ইরিন

যোগাযোগ শঙ্কা কী । Communication Apprehension যোগাযোগ শঙ্কার প্রকারভেদ


যোগা‌যোগ শঙ্কা বল‌তে বুঝায় যোগা‌যোগে অংশ নেয়ার ভী‌তি, অ‌স্হিরতা, উ‌দ্বেগ, দ্বিধা । অর্থাৎ, যোগা‌যোগ কর‌তে একজন মানুষ কতটা ভয় পায় ।

ম্যাক্রসকির মতে, যে ধরনের চিন্তা বাস্তব অথবা অনুধাবনগত যোগাযোগ আচরণে দুশ্চিন্তা বা ভীতির উদ্রেক করে সেগুলোকে যোগাযোগ শঙ্কা বলে।

শ্রোতার চিন্তাভাবনা এবং নিজের ভাবমূর্তি বজায় রাখতে মানুষের মধ্যে এ ধরনের ভীতির উদ্রেক হয়। যোগাযোগ শঙ্কাকে ইংরেজীতে Communication Apprehension বা সংক্ষেপে CA বলা হয়৷

যোগাযোগের বিভিন্ন ধরন যেমন- আন্তঃ ব্যক্তিক যোগাযোগ, দলীয় যোগাযোগ, জনযোগাযোগ ও গণযোগাযোগ- এ চার ধরনের যোগাযোগেই শঙ্কা দেখা যায়।

উদাহরণস্বরূপ,
ক্লাসে প্রেজেন্টেশন চলাকালীন, মাইক্রোফোন হাতে আমাদের অনেক বন্ধুরই হাঁটু কাঁপাকাঁপি শুরু হয়। এটি যোগাযোগ শঙ্কারই বহিঃপ্রকাশ।

আবার, নিজের পছন্দের মানুষটিকে গোলাপ হাতে ভালোবাসার কথা জানাতে গিয়ে অনেক সময় ঘর্মাক্ত হয়ে তোতলাতে তোতলাতে ফিরে আসতে দেখা যায় সুঠামদেহী নায়ককে। এগুলো Communication Apprehension এর বাস্তব উদাহরণ।

এক বা একাধিক ব্যক্তির সাথে বাস্তব অথবা অনুধাবনকৃত যোগাযোগের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি মানসিকভাবে যে ধরনের দুশ্চিন্তার মুখোমুখি হন, তাকে যোগাযোগ শঙ্কা বলে। (ম্যাক্রস্কি ১৯৭৭)




যোগাযোগ শঙ্কার প্রকারভেদ

যোগাযোগ শঙ্কার প্রকারভেদ

এবার শঙ্কার প্রকারভেদ নিয়ে কথা বলা যাক। মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ শঙ্কা দেখা যায়৷ এবং ব্যক্তিবিশেষে এগুলোর ধরনও ভিন্ন হয়। তবে, ম্যাক্রোসকির মতে, মোটা দাগে, যোগাযোগ শঙ্কা মূলত চার ধরনের৷ যথা-

১. বৈশিষ্ট্যগত শঙ্কা (Trait anxiety)

২. পরিপ্রেক্ষিত শঙ্কা (Context anxiety)

৩. শ্রোতানির্ভর শঙ্কা (Audience anxiety)

৪. পরিস্থিতিগত শঙ্কা (Situation anxiety)

আরো জানুন………..সম্পর্ক গঠনের ১০টি ধাপ । 10 Steps to Build Relationship

নিচে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো –

১. বৈশিষ্ট্যগত শঙ্কা Trait Anxiety:

সব মানুষেরই কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। এগুলোকে তার পারসোনালিটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়৷ Trait anxiety হলো এমন শঙ্কা যা ব্যক্তির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হিসেবে কাজ করে। যেমন- আমাদের আশেপাশে এমন অনেকেই আছেন যারা যোগাযোগে তুলনামূলক কম পারদর্শী। একসাথে বেশী মানুষের সাথে বা খুব বেশী মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন না। সাধারণত, এদের আমরা মুখচোরা বলে থাকি। এরা নিজ থেকে যোগাযোগ পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করে।

ম্যাক্রসকি এবং বীটি (Beatty) যদিও বৈশিষ্ট্যগত শঙ্কাকে বংশগত বা Genetic বলে উল্লেখ করেছেন , তবে অন্যান্য যোগাযোগবিদগণ তা মানতে নারাজ। তারা এটিকে আরোপিত হিসেবে দেখিয়েছেন এবং এটি চাইলেই ব্যক্তি অতিক্রম করতে পারেন বলে তাঁদের ধারনা। সময়ের সাথে সাথে অনুশীলন ও কৌশল অনুসরণ করে এ ধরনের শঙ্কা অনেকটাই দূর করা যায়।

২. পরিপ্রেক্ষিত শঙ্কা Context Anxiety:

কোন কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির মধ্যে যে ধরনের যোগাযোগ শঙ্কা কাজ করে তা হলো পরিপ্রেক্ষিতগত শঙ্কা। অর্থাৎ, এখানে কোন কিছুর পরিপ্রেক্ষিতের সাপেক্ষে এ ধরনের শঙ্কা সৃষ্টি হয়৷ যোগাযোগবিদগণ এ ধরনের শঙ্কাকে মনস্তাত্ত্বিক বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

উদাহরণস্বরূপ: ভাইবা বোর্ডে ঢোকার সাথে সাথে আমাদের অনেকেরই হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে যায়, গলা শুকিয়ে যায়। কোন কথার জবাব দিতে পারি না। অথচ সেখানে উপস্থিত বেশীরভাগ শিক্ষক-শিক্ষিকার সাথে ক্লাসে কিংবা ক্লাসের বাইরে আমরা অনায়াসেই যোগাযোগ করতে পারি৷ পরিপ্রেক্ষিতজনিত শঙ্কার সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ হলো জনযোগাযোগ। গবেষণায় দেখা যায় প্রায় ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীই জনযোগাযোগের সময় শঙ্কায় ভোগে। এছাড়াও প্রেজেন্টেশন, দলীয় যোগাযোগ, ও মিটিং এর ক্ষেত্রেও এক ধরনের যোগাযোগ শঙ্কা দেখা যায়।

৩. শ্রোতানির্ভর শঙ্কা Audience Anxiety


এ ধরনের শঙ্কায় ব্যক্তি বিষয়, বস্তু বা পরিস্থিতি নয় বরং শ্রোতাকে নিয়ে বেশী শঙ্কা অনুভব করে। অর্থাৎ, বক্তা যাদের সামনে কথা বলছে বা যাদের উদ্দেশ্যে যোগাযোগ করছে তাঁদের প্রতি শঙ্কা অনুভব করাই হলো শ্রোতার প্রতি শঙ্কা।

উদাহরণস্বরূপ- আমাদের ক্লাসে যখন নতুন কোন শিক্ষক আসেন, তখন প্রথমদিকে তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করেন৷ কিন্তু অন্যান্য শিক্ষক যারা অনেকদিন ধরেই আমাদের ক্লাস নিয়ে আসছেন তাদের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায় না। অর্থাৎ, নতুন শিক্ষক তার অচেনা শ্রোতাদের নিয়ে যোগাযোগ শঙ্কা অনুভব করছেন। এ ধরনের শঙ্কা সাধারণত সবার মধ্যেই কম বেশী দেখা যায়৷ আমরা যাদের সাথে সচরাচর যোগাযোগ করে অভ্যস্ত তাদের সাথে আমরা এক ধরনের একাত্মতা অনুভব করি। কিন্তু নতুন শ্রোতার সাথে যেহেতু পূর্বের তেমন জানাশোনা থাকে না, তাই তাদের কাছ থেকে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া আসবে তা নিয়ে ব্যক্তি শঙ্কা অনুভব করে।

৪. পরিস্থিতিগত শঙ্কা Situation Anxiety)


স্থান, কাল, শ্রোতা এবং বক্তার মেজাজ- সবকিছু মিলিয়েই একটি যোগাযোগ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সাধারণত বক্তা স্বস্তি বোধ করেন, এমন কোন পরিস্থিতির কিছু উপসর্গ যদি বদলে দেওয়া হয়, তবে একই পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও বক্তা যোগাযোগ করার সময় শঙ্কা অনুভব করেন।
ক্লান্তি, তাড়াহুড়ো, ইত্যাদি বিষয়গুলো এ ধরনের শঙ্কা তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

উদাহরণস্বরূপ, আমরা নিজের পরিচয় দিতে সাধারণত গর্ববোধ করি এবং বেশ স্বস্তির সাথেই তা প্রকাশ করি। কিন্তু কোন চাকরির ভাইবা বোর্ডে যখন আমরা নিজের পরিচয় দেই তখন আমরা এ ধরনের যোগাযোগ শঙ্কা অনুভব করি৷

যোগাযোগে নানা ধরনের শঙ্কা আমাদের সবার মধ্যেই দেখা যায়৷ তবে, এগুলো দূর করারও বেশ কিছু উপায় রয়েছে।

লেখক : শিক্ষার্থী

মাস্টার্স (২২ তম ব্যাচ)
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.