আদালত অবমাননা আইন ১৯২৬। Contempt of Court Act 1926

Marjan Akter

 আদালত অবমাননা আইন ১৯২৬। Contempt of Court Act 1926 


আদালত অবমাননা


বর্তমানে মাঝে মাঝেই আদালত অবমাননার অনেক সংবাদ দেখা যায় । আদালত অবমাননা মামলাগুলোর মধ্যে দেখা যায় কেউ নিষ্পত্তি হওয়া মামলার রায়ের বিরুদ্ধে রুঢ় মন্তব্য করেছেন ; আবার কেউ বিচারককে নিগৃহীত করেছেন ; আবার কেউবা বিচারপতি সম্পর্কে আপত্তিকর সমালোচনা করেছেন । এই সকল মন্তব্য ,নিগ্রহ  ও সমালোচনা কখনও কখনও আদালতের নজরে আসে বা আনা হয় এবং মন্তব্যকারী ,সমালোচনাকারী ও নিগ্রহকারীকে আদালতের সামনে জবাবদিহি করতে হয় । অভিযুক্তদের মধ্যে যারা দোষী সাব্যস্ত হয়ে থাকেন তাদের বিভিন্ন দন্ড প্রদান করা হয় ।

আদালতের আদেশ,নির্দেশ এবং আদালতের মর্যাদা সম্পর্কের অবমাননা করাকে ’আদালত অবমাননা’ বলা হয় । আদালত বা বিচারককে কটূক্তি বা মর্যাদাহানীকর উক্তি বা লিখিত বক্তব্য উত্থাপন করার মধ্য দিয়ে আদালতের অবমাননা করা হয় । আদালত চলাকালে বা আদালতের বাইরেও আদালত অবমাননার অপরাধ হতে পারে । আদালত অবমাননা দেওয়ানি বা ফৌজদারি উভয়ই হতে পারে ।


আদালত অবমাননা আইনের উৎপত্তি ও সংশোধন (ইতিহাস ) : 

ভারতীয় উপমহাদেশে ১৯২৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আইন পরিষদে আদালত অবমাননা আইন উপস্থাপন করা হয় । যা ১৯২৬ সলের ১ মে থেকে কার্যকর হয় । বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দীর্ঘদিন ১৯২৬ সালের আইনটি বলবৎ ছিল । কিন্তু ১৯২৬ সালের আইনটিতে আদালত অবমাননার দন্ডের উল্লেখ থাকলেও আদালত অবমাননার সংজ্ঞা দেওয়া হয় নি । ভারত ও পাকিস্থান এ প্রশ্নের সুরাহাকল্পে ১৯৭১ ও ১৯৭৪ সালে নতুন আদালত অবমাননা আইন প্রণয়ন করে ১৯২৬ সালের আইনটি বাতিল করে ।


বাংলাদেশে ১৯২৬ সালের আইনটি কে যুগোপযোগী করার জন্য ২০০৮ সালে আদালত অবমাননা আইন অদ্যাদেশ এবং ২০১৩ সালে আদালত অবমাননা আইন প্রণয়ন করা হয় । ২০১৩ সালের আইন অনুযায়ী (২০ ধারা বলে ) আদালত অবমাননা আইন ১৯২৬ রহিত করা হয় ।




কীভাবে আদালত অবমাননা হয় : 

আদালত অবমাননা আইন ২০১৩ এর ২ নং ধারায় (৬) এ বলা হয়েছে -

  (৬) দেওয়ানি অবমাননা , অর্থ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন আদালতের রায়,ডিগ্রি ,নি্েদশনা,আদেশ,রিট বা কার্যক্রম অবমাননা অথবা আদালতের নিকট প্রদত্ত কোন অঙ্গীকার নামা ভঙ্গ করা ।

 (৮) ফৌজদারী অবমাননা , অর্থ মৌখিক বা লিখিত কোন শব্দ বা চিন্হ দ্বারা বা প্রদর্শনযোগ্য  কোন কিছুর মাধ্যমে এমন কোন কিছু প্রকাশ করা অথবা এমন কোন কার্য করা যাহতে-

 ক) কোন আদালতের কর্তৃত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয় বা হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায় থাকে অথবা উহার কর্তৃত্ব সম্পর্কে অপপ্রচার করা হয় বা অপপ্রচার করা হইয়াছে বা অপপ্রচারের অভিপ্রায় থাকে , বা 

খ) কোন বিচারিক কার্যধারা ক্ষুন্ন করা হয় অথবা উহাতে হস্তক্ষেপ করা হয় বা হস্তক্ষেপের অভিপ্রায় থাকে , বা

গ) অন্য কোনভাবে চলমান বিচারিক কার্যধারার স্বাভাবিক গতিধারাকে বাধাগ্রস্ত করে বা হস্তক্ষেপ করে বা বাধাগ্রস্থ করিবার বা হস্তক্ষেপ করিবার অভিপ্রায় থাকে ।

 ৯) বিচারিক কার্যধারা, অর্থ আদালতে রুজুকৃত এমন কোন আইনগত কার্যধারা যাহা অনিষ্পন্ন রহিয়াছে বা যাহার বিরুদ্ধে কোন আইনের অধীন দায়ের আপীল ,রিভিশন বা রিভিউ চূড়ান্ত ভাবে নিষ্পত্তি হয় নাই বা যাহার বিরুদ্ধে উক্তরুপ কার্যধারা গ্রহণের জন্য কোন আইন দ্বারা নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রান্ত হয় নাই ; এবং উহা হইতে উদ্ভূত জারী কার্যক্রম ও অনুরুপ কার্যধারার অংশ বলিয়া গণ্য হইবে ।

এছাড়া, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৮০ নং ধারা অনুসারে দেওয়ানি , ফৌজদারি ও রাজস্ব আদালতের উপস্থিতিতে দন্ডবিধি 

১) ১৭৫ ধারা অনুসারে, আইনে দলিল দাখিল করতে বাধ্য এমন কোনো ব্যক্তি দলিল দাখিলে অবহেলা করে 

২) ১৭৮ অনুসারে, শপথ নিতে বাধ্য কিন্তু শপথ গ্রহণ না করলে , 

৩) ১৭৯ অনুসারে, আইনগত  উত্তর না  দিয়ে সত্য গোপণ করে, 

৪) ১৮০ অনুসারে, আইনগত     প্রযোজ্য অথচ কোনো ব্যক্তি যদি বিবরণ দিয়ে তা স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে ।

৫) ২২৮ অনুসারে বিচারিক কাজে নিয়োজিত কেউ ইচ্ছা করে আদালত অবমাননা  করে বা কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে । তবে আদালত অবমাননা আইনে শাস্তি প্রদান করা হবে ।


আদালত অবমাননার গুরুত্বপূর্ণ ধারা সমূহ : ৪,৫,৬,৭,১১,১৩ 

মূলত ৪-১০ ধারায় কোন কার্যসমূহ আদালত অবমাননা হবে না তার বর্ণনা


ধারা -৪  : নির্দোষ প্রকাশনা বা বিতরণ অবমাননা নয় , 

১) মৌখিক বা লিখিত কোন শব্দ বা চিত্র দ্বারা বা প্রদর্শনযোগ্য কোন কিছুর মাধ্যমে , বা অন্য কোনভাবে এমন কিছু প্রকাশ করিয়াছেন যাহা উক্তরুপ প্রকাশনার সময় আদালতে বিচারাধীন দেওয়ানি বা ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ বা বাধা প্রদান করে । যুক্তি সঙ্গত কারণে বিচারাধীন 

২) প্রকাশনার সময় নিষ্পন্নাধীন ছিল না 

৩) বিতরণ করার সময় প্রকাশনার অনুরুপ কোন বিষয় থাকার সম্ভাবনা

ধারা -৫ : পক্ষপাতহীন ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ আদালত অবমাননা নহে । 


ধারা-৬ : অধস্তন আদালতের সভাপতিত্বকারী বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ যখন আদালত অবমাননা নয় ।

 কোন ব্যক্তি কোন অধস্তন আদালতের সভাপতিত্বকারী বিচারক সম্পর্কে সরল বিশ্বাসে যদি 

ক) অন্য কোন অধস্তন আদালতের নিকট বা 

খ)সুপ্রিম কোর্টের নিকট কোন বিবৃতি বা মন্তব্য প্রদান করেন ,তাহা হইলে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী হইবেন না


ধারা-৭ :  কতিপয় ক্ষেত্র ব্যতীত খাস কামরায় বা রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠিত প্রক্রিয়া সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ আদালত অবমাননা নহে । 

এই আইনের অধীনে যা কিছুই থাকুক , খাস কামরায় বা রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠিত বিচারিক কার্যধারা সম্পর্কে কোন ব্যক্তির পক্ষপাতহীন ও বস্তুনিষ্ট তথ্য প্রকাশ আদালত অবমাননা হবে না । 

তবে - অন্য কোন আইনের লঙ্ঘন, জনস্বার্থে উক্ত তথ্য প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা থাকলে, জন-শৃঙ্খলা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কারণে , আবিস্কার বা উদ্ভাবন সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করলে অবমাননা হবে ।


ধারা -৮ : আত্মপক্ষ সমর্থনে অন্য কোন যুক্তি প্রদানের ক্ষেত্রে এই আইন বাধা হবে না ।


 ধারা -৯ : আদালত অবমাননার পরিধি বিস্তৃত না হওয়া 


ধারা -১০ : কতিপয় কার্য আদালত অবমাননা নয় 

১) প্রচলিত আইন,বিধিমালা,সরকারি নীতিমালা অনুসরণ করে জনস্বার্থে ও সরল বিশ্বাসে কৃত কাজ ।

 ২)আদালতের কোন রায় আদেশ বা নির্দেশ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কোন ব্যক্তির পক্ষে যথাযথ প্রচেষ্ঠা সত্ত্বেও বাস্তবায়ন অসম্ভব হলে ।

ধারা- ১১ : আদালত অবমাননা অভিযোগ দায়ের ও নিষ্পত্তির বিধান : 

১) কোন ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ উত্থাপিত বা কার্যধারা রুজু করা হলে , তাকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেয়া হবে । কারণ দর্শানোর জবাব সন্তোষজনক হলে অব্যাহতি দেয়া হবে ।কারণ দর্শানোর জবাব সন্তোষজনক হলে অব্যাহতি দেয়া হবে । সন্তোষজনক না হলে উক্ত ব্যক্তির নিয়োজিত আইনজীবীর মাধ্যমে ব্যক্তব্য প্রদানের সুযোগ প্রদান করা হবে ।

২) আইনজীবী না থাকলে নিজেও বক্তব্য দিতে পারবে বা মামলা পরিচালনা করতে পারবে । 

৩) অভিযুক্ত ব্যক্তির উপস্থিতিতে অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্য ,শুনানি ও সাক্ষ্যদানের সুযোগ ।

৪) নিয়োজিত আইনজীবী দ্বারা মামলা পরিচালনা করতে পারবে । 

৫) মামলা পরিচালনার জন্য নির্ধারিত অর্থ সরকারী খাত থেকে অগ্রীম গ্রহণ করতে পারবে । অব্যহতি পেলে পরিশোধ করতে হবে না । দোষী হলে পরিশোধ করতে হবে । 

৬) প্রজাতন্ত্রের কার্যে স্থায়ীভাবে কর্মাবসান হলে অব্যাহতি প্রদান করতে পারবে । 

৭) স্থলাভিষিক্ত ব্যক্তির কারণ দর্শানো


ধারা -১৩ আদালত অবমাননার শাস্তি : 

১) দোষী সাব্যস্ত হলে অনূধর্ব ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক ২০০০ টাকা জরিমানা অর্থদন্ড । নি:শর্ত ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করলে অব্যহতি দিতে পারে । 

২) শাস্তি পাওয়ার পর অনুতৃপ্ত হয়ে নি:শর্ত ক্ষমা চায়লে আদালত সন্তুষ্ঠ হলে আরোপিত দন্ড মাফ বা হ্রাস করতে পারে । 

৩) আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন 

ক) কোনো আদালত চায়লে অতিরিক্ত শাস্তি প্রদান করতে পারে । 

খ) দেওয়ানি অবমাননায় আদালত  যদি মনে করে শুধু অর্থদন্ড দিলেই হবে না , তাহলে অনূধর্ব ৬ মাসের কারাদন্ডও দিতে পারবে ।

অতিরিক্ত তথ্য : 

১. আদালত অবমাননা আইনে সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিক এ দুইটি শ্রেণীকে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে যা বৈষম্যমূলক । 

২) আইনটিতে আদালতের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে । যা সংবিধানের ২৭,১০৮ ও ১১২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী । 

৩. আদালত অবমাননা ৩ ধরনের 

ক . আদালতের কার্যক্রমের চলমান থাকাবস্থায় 

খ. আদালতের আদেশ অমান্য 

গ. আদালতের বাইরে কোন সভা সমাবেশ বা নিবন্ধ


লেখক : শিক্ষার্থী ,৪র্থ বর্ষ

যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.