এলটন মায়োর হাথর্ন স্টাডিস । Hawthorne Studies of Elton Mayo
এলটন মায়োর হাথর্ন স্টাডিস Hawthorne Studies of Elton Mayo
মানবিক সম্পর্কের ক্লাসিক্যাল থিউরি
এলটন মায়ো : Elton Mayo
জর্জ এলটন মায়ো (২৬ ডিসেম্বর ১৮৮০ -৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯) অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণকারী মনোবিজ্ঞানী ,শিল্প গবেষক এবং সাংগঠনিক তত্ত্ববিদ ছিলেন । মায়ো প্রায়শই বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের যুদ্ধের চাপ থেকে বা তাড়না থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে সহায়তা করতেন । ১৯১১ থেকে ১৯২২ পর্যন্ত University of Queensland এ মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন । ১৯২৬ সালে হার্ভাড বিজনেস স্কুলের গবেষণার অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন । ব্যবস্থাপনা , শিল্প সমাজবিজ্ঞান, দর্শন এবং সামাজিক মনোবিজ্ঞান সহ বেশ কয়েকটি শাখায় মায়ো কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ।
Hawthorne Studies
হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা টিম ১৯২০ থেকে ১৯৩৩ সালে Western Electric Company তে একাধিক গবেষণা কার্য পরিচালনা করে । যার প্রধান ছিলেন এলটন । মায়ো ও তার টিম (ফ্রিটজ রোথলিসবার্গার ও ডিকসন ) মানুষের আচরণের সামাজিক , মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো অন্তর্ভুক্ত করে গবেষণা পরিচালনা করে উৎপাদনের উপর তা কিভাবে প্রভাব ফেলে তা পর্যবেক্ষণ করেছেন । এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল মানবিক আচরণের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ করা । চারটি ধাপে এই গবেষণা কাজটি পরিচালিত হয় ।
১ . আলোকসজ্জা পরীক্ষা Illumination Experiment
২. রিলে সমাবেশ রুম পরীক্ষা Relay Assembly Test Room Experiment
৩. গণ সাক্ষাৎকার কার্যক্রম Mass Interview Program
৪. ব্যাংক ওয়ারিং পর্যবেক্ষণ পরীক্ষা Bank Wiring observation Room Experiment
১. আলোকসজ্জা পরীক্ষা : Illumination Experiment
Illumination শব্দের অর্থ আলো বা লাইট । এই পর্যায়ে আলোর পরিমাণ বাড়িয়ে-কমিয়ে গবেষণা করা হয়েছিল । সাধারণত কারখানায় কাজ করতে গেলে আলোর বেশ প্রয়োজন। আলো ছাড়া কাজ করা সম্ভব নয় । এই পর্যায়ে গবেষকরা দেখতে চেয়েছিলেন আলোর পরিমাণ বাড়লে বা কমালে কাজে কোনো প্রভাব ফেলে কি না । অর্থ্যাৎ, এই পর্যায়টি করা হয়েছিলো আলোর পরিমাণ বাড়লে উৎপাদন বাড়বে ‘ এটি প্রমাণ করার জন্য ।
পরীক্ষা :
প্রথমত কর্মীদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল । প্রথম ভাগ ছিল নিয়ন্ত্রক গ্রুপ । যাদের মাঝে আলোর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি ।এবং ২য় গ্রুপ ছিল গবেষণা গ্রুপ যাদের উপর আলোর প্রভাব কম= বেশি করে উৎপাদনের হ্রাস-বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল । গবেষণা গ্রুপের প্রথমত আলোর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল যার ফলে উৎপাদন বেড়ে যায় । আবার ২য় ধাপে আলোর পরিমাণ একটু কম করা হয় কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কোনো পরিবর্তন হয় নি । উল্টো বেড়ে যায় ।৩য় ধাপে একদম কমিয়ে দেয়া হয় যার ফলে উৎপাদন একটু কমে যায় ।
অর্থ্যাৎ , গবেষকরা এই পরিণতিতে আসেন যে উৎপাদন বৃদ্ধিতে আলোর কোনো প্রভাব নেই । শুধুমাত্র অসহনীয় মাত্রায় চলে গেলে তখনই উৎপাদন কমে যায় । ফলে গবেষকরা ২ য় ধাপে অগ্রসর হন ।
২. রিলে সমাবেশ রুম পরীক্ষা : Relay Assembly Test Room Experiment
এটি কিছু নারী দলের উপর করা হয় । চাকরীর বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তনের কারণে উৎপাদনে কোনো প্রভাব পড়ে কিনা পর্যবেক্ষণ করার জন্য এ ধাপটি পরিচালিত হয় ।
পরীক্ষা :
গবেষকরা প্রথমত ২ জন নারীকে বলেন এমন কিছু সহকর্মী বাছাই করে নিতে , নিজের ইচ্ছামতো যাদের সাথে তারা নিজেরা কাজ করতে চায় । তারপর ৩য় ধাপে তাদের বলা হয় ২টি জিনিসের ভিত্তিতে তাদের কাজ যাচাই করা হবে । আর এগুলো হলো গতি এবং ধারাবাহিকতা । তারপর তাদের বলা হয় ৪-১২ সপতাহ এই পরীক্ষা চলতে থাকবে ।
মেয়েদের সাথে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল যিনি তাদের কাজ পর্যবেক্ষণ করতেন । কোনো রকম পরিবর্তনের আগে মেয়েদের সাথে কথাব বলে নেয়া হতো । তাদের নিজেদের মতামত দেয়ার সুযোগ দেয়া হতো । কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের নিজেদেরই মতামত দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিলো ।
পরিবর্তন :
১. প্রণোদনামূলক বেতন /পুরস্কার বৃদ্ধি : বলা হয়েছিলো এক্ষেত্রে পুরো টিমের কাজ দেখা হবে ।
২. ব্রেক পিরিয়ড : প্রথমে বার বার ব্রেক দেয়া হয়েছিলো যার ফলে মেয়েরা জানায় বার বার ব্রেক তাদের কাজের গতিকে হ্রাস করে দেয় । তারপর ব্রেক পরিবর্তন করে মাত্র ২ বার দেয়া হয় । একবার সকালে , অন্যটি বিকালে এবং ২টি ব্রেকই ৫ মিনিট থেকে ১০ মিনিটে বাড়ানো হয়েছিলো । যার ফলে দেখা যায় উৎপাদন বেড়ে গেছে ।
ফলাফল :
১. উৎপাদন বৃদ্ধি
২. পরিবর্তনের কারণে অনুপস্থিতি কমে গেল
৩. প্রণোদনা/প্রেরণা বেড়ে গেল
৪. সুপারভাইজারের প্রয়োজন কমে গেলে
৫. কাজের প্রতি আগ্রহ
আশ্চর্যজনকভাবে যখন সকল সুবিধা ফিরিয়ে নিয়ে আবার আগের মতো অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হলো , কোনো বিশ্রাম নেই , পুরস্কার নেই ,তবুও তাদের উৎপাদনের পরিমাণে কোনো হ্রাস পায় নি । কারণ প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের সম্পর্ক গভীর হয় এবং ইতিবাচক মনোভাব বেড়ে গিয়েছিলো । কর্মীদের মেয়েদের মধ্যে নিজের সিদ্ধান্তও নিজে নেয়া খূবই খুবই ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিলো । কোম্পানি ,কর্মী ও সুপারভাইজারদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নতি হয় ।
৩. গণ সাক্ষাৎকার কার্যক্রম Mass Interview Program
এ কাজে ২০ হাজার লোকের সাক্ষাতকার (১৯২৮-১৯৩০ ) নেওয়া হয় । কোম্পানি, বেতন, সুপারভিশন, উন্নতি ও ইনসুরেন্সের প্রতি কর্মীদের মনোভাব জানতে চাওয়া হয় । তাদের নিজেদের মতামত চাওয়া হয় এই জিনিসগুলো কেমন হওয়া উচিত । প্রথমে সাক্ষাতকার হ্যাঁ বা না উত্তরের মাধ্যমে নেয়া হয় । যার ভালো ফলাফল না পেয়ে প্রশ্নের ধরন পরিবর্তন করে তারা যেনো মত দিতে পারে এমন প্রশ্ন রাখা হয় । যা খুবই কার্যকর হয় ।
ফলাফল:
১. সম্মান করলে কর্মীর মনোভাবও ভালো হবে , সম্মান না করলে নেতিবাচক ।
২. কর্মীদের কিছু সামাজিক চাহিদা আছে যা পূরণ কাজে ইতিবাচক প্রভাব পাওয়া যায় ।
পরবর্তী ধাপে যাওয়ার আগে কর্মীরা বুঝতে পারলেন -
১. দলগত আচরণের ব্যাপক প্রভাব আছে
২. ছোট দলে কর্মীদের আচরণ কেমন হবে ? জানতে পরবর্তী ধাপে গবেষণা করলেন ।
৪. ব্যাংক ওয়ারিং পর্যবেক্ষণ পরীক্ষা Bank Wiring observation Room Experiment
এ পর্যায়ে ১৪ জন পরুষ কর্মীর উপর গবেষণা করা হয় যারা টার্মিনাল ব্যাংকে এসেম্বলির কাজ করতো ।এখানে গবেষকদের প্রত্যাশা ও বাস্তবতায় অনেক পার্থক্য দেখা যায় । গবেষকরা ভেবেছিল যারা ভালো কাজ করে, ভালো অবস্থানে আছে তারা অন্যদের উপর প্রভাব ফেলবে । তারাও যেন ভালো করে কাজ করে । কিন্তু এমনটি হয় নি । তারা অন্যের উপর প্রভাব খাটায়নি কারণ তারা ভেবেছিল এরূপ করা হলে তাদের গ্রুপ থেকে বের করে দেয়া হবে । আবার তারা বাড়তি কাজও করে নি । কারণ তারা ভেবেছিলো অধিক কাজ করলে পরবর্তীতে কোম্পানিতে আর কোনো কাজ থাকবে না । ফলে তাদের চাকরিও চলে যেতে পারে । তাদের অন্য আরেকটি ধারনা ছিল তারা বেশি কাজ করলে যারা কম কাজ করে তাদের বের করে দেয়া হবে । তাই সামাজিক দলের অংশ হিসেবে ভূমিকাই মূখ্য হয়ে ওঠে ।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল বা ব্যাখ্যা :
১. কাজের সাথে কর্মীর সম্পর্ক বেশ গভীর
২. সামাজিক চাহিদা ( প্রেষিত হতে হলে শুধু আর্থিক নয় সামাজিক চাহিদাগুলোও গুরুত্বপূর্ণ )
৩. কোম্পানিকে কর্মীদের দলভিত্তিক আচরণ বুঝতে হবে ।
৪. কর্মীদের সম্মান ও স্বাধীনতা
৫ . কাজে গ্রুপের প্রভাব অনেক বেশি
লেখক : শিক্ষার্থী , ৪র্থ বর্ষ
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments