নির্ভরশীলতা তত্ত্ব |উন্নয়ন ও নির্ভরতার আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে নির্ভরশীলতা তত্ত্ব

নির্ভরশীলতা তত্ত্ব  Dependency Theory

এ.জি.ফ্রাংক এর দৃষ্টিতে নির্ভরশীলতা তত্ত্ব , রাউল প্রোবিমের দৃষ্টিতে নির্ভরশীলতা তত্ত্ব ,পল ব্যরনের দৃষ্টিতে নির্ভরশীলতা তত্ত্ব

উন্নয়ন ও নির্ভরতার আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে নির্ভরশীলতা তত্ত্ব

বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো অনুন্নত কেন , কীভাবে উন্নয়ন অর্জিত হতে পারে ? এসব প্রশ্ন থেকেই উন্নয়ন সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো। ফলশ্রুতিতে গড়ে ওঠে অনেক উন্নয়ন তত্ত্ব। এসব উন্নয়ন তত্ত্বের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তত্ত্ব হলো আধুনিকরণ তত্ত্ব । ১৯৫০ এর দশকে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন তাত্ত্বিক এর মতে, অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন অর্জন করতে হলে পাশ্চাত্যে উন্নয়ন মডেলেই তা করতে হবে।

কিন্তু কাঠামোবাদী নব্য মাকর্সবাদী কিছু চিন্তাবিদ আধুনিকরণ তত্ত্বকে সরাসরি চ্যালেন্জ করেন এবং ১৯৭০ ১৯৮০ এর দশকে নিজেদের তত্ত্বের ব্যাপক বিকাশ ঘটান। এই তত্ত্বটিই নির্ভরশীলতা তত্ত্ব নামে পরিচিত। এই তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মূল বক্তব্য হলউন্নয়নশীল দেশগুলোর অনুন্নয়নের কারণ আভ্যন্তরীণ নয় বরং বাহ্যিক। তাঁদের মতে, উন্নত বিশ্বের শোষণ, শ্রম পাচার, কাঠামোগত নির্ভরশীলতাই উন্নয়নশীল দেশগুলো অনুন্নয়নের মূল কারণ। এসব দেশকে যদি উন্নতি অর্জন করতে হয় তাহলে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর উপর কাঠামোগত নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।




নির্ভরশীলতা তত্ত্বের নির্ভরশীলতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে। তবে নির্ভরশীলতা তত্ত্বের প্রেক্ষাপটে নির্ভরশীলতা হলো উন্নত দেশগুলোর উপর উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক , রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি দিক থেকে নির্ভরশীলতা রয়েছে।

The concise oxford dictionary of sociology তে নির্ভরশীলতাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে – ‘কিছু তত্ত্বের বিন্যাস, যা উন্নত পুঁজিবাদী বিশ্বের উপর নির্ভরশীলতার কারণে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর পর্যাপ্ত ও টেকসই উন্নয়ন অর্জনে ব্যর্থতা বিশ্লেষণ করে’।

নির্ভরশীলতা তত্ত্বসমূহ আধুনিকীকরণ তাত্ত্বিকদের উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে পাশ্চাত্যের ন্যায় উন্নয়ন অর্জন করার আশাবাদী দাবির বিরোধীতা করে।

নির্ভরশীলতা কথাটি একটি অবস্থার বর্ণনা করে যাতে উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে উন্নত, শিল্পায়িত দেশগুলো থেকে আমদানির উপর নির্ভর করে। এসব আমদানি দ্রব্য হচ্ছে- আর্থিক ও কারিগরি সাহায্য, বিশেষজ্ঞ বা সামরিক সমর্থন।

মূলত: নির্ভরশীলতা হচ্ছে- দুই ধরনের দেশের মধ্যে অসম আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। এক ধরনের দেশগুলোকে কেন্দ্র এবং অন্য ধরনের দেশগুলোকে বলা হয় প্রান্ত। কেন্দ্র উন্নত পুঁজিবাদের এবং প্রান্ত অনুন্নত অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে। নির্ভরশীলতা তাত্ত্বিকেরা নির্ভরশীলতাকে মনে করেন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের সীমিত অবস্থা।

আরো জানুন……..মিডিয়া, সমাজ, রাজনীতি ও সাংস্কৃতি  সম্পর্কিত আরো আর্টিকেল পেতে এখানে ক্লিক করুন

পটভূমি:                                                            

নির্ভরশীলতা প্যারাডাইসের তাত্ত্বিক উৎস নিহিত ১৯৪৭ সালে স্থাপিত United Nations Economic Commission for Latin America (ECLA) এবং এর সেক্রেটারী জেনারেল রাউল প্রোবিশের চেতনা, কর্ম এবং লেখার মধ্যে নির্ভরশীলতা তত্ত্ব মোট দুটি ভাবধারার সন্ধিস্থল থেকে উৎসারিত। এগুলো হল-

ক) নব্য মার্কসবাদ

নব্য মার্কসবাদ মৌলিক মার্কসবাদী তত্ত্বের একটা বিশেষ ধারনাকে চ্যালেন্জ করে। এই ধারনা হচ্ছে-

ধনতান্ত্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ইউরোপীয় দেশগুলোর ন্যায় একইভাবে অন্যান্য দেশব্যপী লাভ করবে। আর এর বিকাশ ঘটবে উপনিবেশবাদের মাধ্যমে। তবে ষাটের দশকে এসে অনেক তাত্ত্বিক এই ধারনা বদলে ফেলেছেন। তারা ভাবেন, ধনতন্ত্রের বিকাশই অনুন্নয়নের মূল কারণ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Monthly Review Group এর অন্যতম সদস্য পল ব্যারন বলেন, ধনতন্ত্রের উত্তরণ সফলভাবে ঘটলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সামন্তবাদ ও ধনতন্ত্রের মাঝামাঝি স্থবিরতা বিরাজ করছে।

নব্য মার্কসবাদীরা সাম্রাজ্যবাদকে প্রান্তিক সমাজের দৃষ্টিতে দেখেছেন। মার্কসের বিশ্লেষণ ইউরোপ কেন্দ্রিক। আর নয়া মার্কসবাদী এর ব্যাখ্যার ভিত্তি হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লবী সংগ্রাম যেখানে কৃষক সমাজকে সংগ্রামী ভূমিকায় দেখানো হয়।

খ) ল্যাটিন আমেরিকার উন্নয়ন সম্পর্কিত আলোচনা ফোরাম

নির্ভরশীলতা তত্ত্বের দ্বিতীয় উৎস হলো লাতিন আমেরিকার অনুন্নয়ন নিয়ে গবেষণা । যার ভিত্তিতে ১৯৩০ এর মন্দাভাবের লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের দৈন্য দশা ও নির্ভরশীল অবস্থা। এর সাথে যুক্ত হয় ECLA এর ইতিহাস। ১৯৪৮ সালে EECE (European Economic Commission of Europe) গঠিত হয়। যা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে যুদ্ধ বিধ্বস্ত অবস্থা পূর্ণবাসনের জন্য এবং এশিয়াতে ECAFE গঠন হয়েছিল। পরে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ESCAP। তবে নির্ভরশীলতা তত্ত্বে সবচেয়ে বড় অবদান রাখেন আর্জেন্টাইন অর্থনীতিবিদ রাউল প্রোবিশ।

নির্ভরশীলতা তত্ত্বের উল্লেখযোগ্য অনুমানসমূহ

নির্ভরশীলতা তাত্ত্বিকদের চিন্তার ক্ষেত্রে, কিছু মৌলিক বিষয় মিল থাকলেও বৈচিত্র বিদ্যমান। এর মূল কারণ হল- চিন্তার পটভূমিতে পার্থক্য, চিন্তাবিদদের জাতীয়তা ও মতাদর্শগত পার্থক্য, বিশেষ উপাদানে গুরুত্ব প্রদানে পার্থক্য ইত্যাদি। এ সত্ত্বেও এ, ওয়াই, সো নির্ভরশীলতা তত্ত্বে কয়েকটি মৌলিক অনুমানের উল্লেখ করেছেন। সে গুলো সকল চিন্তাবিদের মধ্যে বিদ্যমান-

১) সাধারণ প্রক্রিয়া

নির্ভরশীলতা একটি সাধারণ প্রক্রিয়া যা তৃতীয় বিশ্বের সকল দেশের জন্য প্রযোজ্য। এ তত্ত্বে ষোল শতক থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত পুঁজিবাদের ইতিহাস ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং নির্ভরশীলতার ধরণ অনুসন্ধান করা হয়েছে।

২) বাহ্যিক ব্যাপার

নির্ভরশীলতা একটি বাহ্যিক ব্যাপার। যা বাইরে থেকে তৃতীয় বিশ্বের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ সীমাবদ্ধতা নয় বরং ঔপনিশিক শাসকদের শোষণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসম অর্থনৈতিক সম্পর্ক দেশের উন্নয়নের প্রধান বাধা বলে তত্ত্বে মনে করা হয়।

৩) অর্থনৈতিক ব্যবস্থা

নির্ভরশীলতাকে মূলত একটি অর্থনৈতিক অবস্থা হিসেবে দেখা হয়। নির্ভরশীলতা সৃষ্টি এবং অব্যাহত অস্তিত্ব মূলত অর্থনৈতিক উদ্বৃত্ত পাচারের উপর নির্ভরশীল।

৪) বিশ্ব অর্থনীতির আঞ্চলিক মেরু করণ

নির্ভরশীলতাকে বিশ্ব অর্থনীতির আঞ্চলিক মেরু করণ হিসেবে দেখা হয়। পুঁজিবাদী দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বৃত্ত শোষণ করে। যার ফলে কেন্দ্রের পুঁজিবাদী দেশগুলোতে উন্নয়ন এবং প্রান্তের দেশগুলোতে অনুন্নয়ন ঘটে। এভাবে নির্ভরশীলতা বিশ্ব অর্থনীতি আঞ্চলিক মেরুকরণের জন্ম দেয়।

৫) উন্নয়নের সাথে অসংগতিপূর্ণ

নির্ভরশীলতাকে উন্নয়নের সাথে অসংগতিপূর্ণ বলে মনে করা হয়। নির্ভরশীলতার কেন্দ্রে উন্নয়ন ঘটলেও প্রান্তের দেশগুলাতে উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। প্রান্তের কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্ন উন্নয়ন সাধিত হলেও তা প্রকৃত উন্নয়ন নয়।

নির্ভরশীলতা তত্ত্বের উল্লেখ্যযোগ্য প্রবক্তাগণ

নব্য মার্কসবাদী ও কাঠামোবাদী তাত্ত্বিকরা (১৯৭০-১৯৮০) এর দশকে নিজেদের তত্ত্বের ব্যাপক বিকাশ ঘটান। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- Poul Baron, A.G.Frank, Raul Prebish, Samir Amin, Dos Santos। এরা নির্ভরশীলতা তত্ত্বের তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত।

রাউল প্রোবিমের দৃষ্টিতে নির্ভরশীলতা তত্ত্ব

রাউল প্রোবিশ কাঠামোগত তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা। তবে তিনি নির্ভরশীলতা তত্ত্বের পটভূমি রচনা করেন। প্রোবিশের নেতৃত্বে ECLA ল্যাটিন আমেরিকার অনুন্নয়নের কারণ ব্যাখ্যা করেছে এবং উন্নয়নের বিকল্প কৌশলেরও সুপারিশ করেছে।

ক) কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা

কমিশনের মতে, কাঠামোগত ভারসম্যহীনতার কারণে কেন্দ্র উন্নত হলেও প্রান্ত অনুন্নত রয়ে যাচ্ছে । এখানে আরও বলা হয়, অনুন্নয়ন ও অ-উন্নয়ন এক কথা নয়। অ-উন্নয়ন বলতে উন্নয়নের অভাব বোঝায়, তবে অনুন্নয়ন বলতে কোন প্রক্রিয়ায় ফলাফল বোঝায়। এজন্য বিশ্বের কিছু অংশ উন্নত হয়েছে এবং এর ফলাফল হিসেবে বাকী অংশ অনুন্নয়নের শিকার হয়েছে।

খ) অসম বাণিজ্যিক সম্পর্ক

প্রোবিশ মনে করেন, পুঁজিবাদী প্রান্তের দেশগুলোতে বিকাশিত না হওয়ার কারণে কেন্দ্র ও প্রান্তের মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্কে কেবল কেন্দ্রই লাভমান হয় এবং প্রান্ত ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এর মূল কারণ কেন্দ্র ও প্রান্তের কাঠামোগত সম্পর্ক। সাধারণত , প্রান্ত প্রাথমিক পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করে এবং আমদানি করে শিল্প পণ্য।

গ) একচেটিয়া পুঁজিবাদ

প্রোবিশ মনে করেন, প্রান্তের দেশগুলোতে প্রযুক্তিতে উন্নয়ন অর্থই হচ্ছে কেন্দ্র থেকে প্রযুক্তি আমদানি করা। যার সুফল কেন্দ্র ভোগ করে। তার মতে, পুঁজিবাদী উৎপাদনে পদ্ধতি থেকে প্রান্তের দেশগুলো লাভবান হতে পারে না। কারণ প্রান্তের পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটা অসম্ভব ব্যাপার।

কাজেই ল্যাটিন আমেরিকার উন্নয়নের জন্য এরূপ কাঠামোগত নির্ভরশীলতা সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

পল ব্যারনের দৃষ্টিতে নির্ভরশীলতা তত্ত্ব

পুঁজিবাদী উন্নয়নের ভাবনার বিরুদ্ধে প্রথম চ্যালেন্জ উত্থাপন করেন পল ব্যারন ১৯৫০ এর দশকে মার্কসবাদী ব্যারন উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনুন্নয়নের কারণ কী? এ প্রশ্নের উত্তরে প্রধানত দুটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

ক) ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

 খ) সাম্রাজ্যবাদী শোষণ

ব্যারন মনে করেন, বর্তমানের উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো এক সময় পৃথিবী ব্যাপী উপনিবেশ স্থাপন করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শোষণ করেছে। ফলে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে পুঁজি কেন্দ্রীয়করণ হয়েছে। নিজেদের শোষণকে নিশ্চিত করার জন্য উপনিবেশ পুরাতন প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে দিয়ে এমন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে যেগুলো সাম্রাজ্যবাদী শোষণের সহায়ক হয়।

এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ভারতের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ভারতকে যদি ব্রিটিশ শোষণ না করত এবং দেশটিকে যদি স্বাধীনভাবে তার ভাগ্য নির্ধারণ করার সুযোগ দেওয়া হত, তা হলে- আজকের ভারত অনেক উন্নত হতে পারত। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক শোষণের অনুপস্থিতি কীভাবে উন্নয়ন সম্ভাবনাকে বিকাশিত করে, সে প্রসঙ্গে জাপানকে উল্লেখ করেন।

তিনি মন্তব্য করেন, জাপানের অর্থনৈতিক সাফল্যের মূল কারণ হচ্ছে অব্যহত রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে মুক্ত অবস্থা। তাই তিনি এসব দেশকে অনুন্নয়ন থেকে উত্তরণের জন্য সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সুপারিশ করেন।

এ.জি. ফ্রাংক এর দৃষ্টিতে নির্ভরশীলতা তত্ত্ব

এ.জি. ফ্রাংক নির্ভরশীলতা তত্ত্বের সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য তত্ত্বিক। তিনি পল ব্যারনের অনুসারী হলেও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, নব্য মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উন্নয়ন ও অনুন্নয়নকে ব্যাখ্যা করেছেন। ল্যাটিন আমেরিকার অনুন্নয়নের পটভূমিতে ফ্রাংক তার নির্ভরশীলতা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। প্রথমেই তিনি পুঁজিবাদের তীব্র সমালোচনা করেন এবং তিনটি প্রধান স্ববিরোধীতা তুলে ধরেন-

ক) অনেকের নিকট থেকে উদ্বৃত্ত শোষণ ও কতিপয়ের আত্মসাৎ।

খ) মেট্রোপলিটন কেন্দ্র ও প্রান্তিক স্যাটেলাইটে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মেরুকরণ।

গ) পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মৌল কাঠামোর ধারাবাহিকতা।

ফ্রাংক উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোকে মেট্রোপলিটন ‍ও অনুন্নত দেশগুলোকে স্যাটেলাইট নামে অবহিত করেছেন। এর প্রক্ষিতে ফ্রাংক বলেন, পুঁজিবাদের এসব স্ববিরোধীতা এবং ঐতিহাসিক উন্নয়ন উদ্বৃত্ত আত্মসাৎকৃত প্রান্তিক স্যাটেলাইটে অনুন্নয়ন ঘটিয়েছে। অন্যদিকে উদ্বৃত্ত আত্মসাৎকারী মেট্রোপলিটন কেন্দ্রে উন্নয়ন ঘটিয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া অদ্যবাধি চলছে। ফ্রাংক তার Fundamental of Marxism and lenixism গ্রন্থে মন্তব্য করেন। পুঁজিবাদের চরম স্ববিরোধীতা হলো একই দেশ ও অঞ্চলের মেট্র্রোপলিটন ও স্যাটেলাইট সম্পর্ক বিদ্যমান।

যেমন- শহর ও গ্রামের অসম উন্নয়ন। স্থানীয়, আঞ্চলিক, জাতীয় এভাবে নিম্ম পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ মেট্রোপলিটনের সাথে সম্পর্ক যুক্ত। আন্তর্জাতিক মেট্রোপলিটনের তুলনায় জাতীয় কেন্দ্রগুলো স্যাটেলাইট, জাতীয় মেট্রোপলিটনের তুলনায় আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো স্যাটেলাইট এবং আঞ্চলিক মেট্রোপলিটনের তুলনায় স্থানীয় কেন্দ্রগুলো স্যাটেলাইট। এখান থেকেই বোঝা যায়, প্রতিটি পর্যায়ে মেট্রোপলিটন কর্তৃক স্যাটেলাইট উদ্বৃত্ত শোষণ, যা মেট্রোপলিটনের উন্নয়ন এবং স্যাটেলাইটে অনুন্নয়নের জন্ম দেয়।

নির্ভরশীলতা তত্ত্বের সমালোচনা

নির্ভরশীলতা তত্ত্বে তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোর উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন সংক্রান্ত তাৎপর্যপূর্ণ তত্ত্ব হিসেবে স্বীকৃত। বিশেষ করে, লাতিন আমেরিকার পরিপ্রেক্ষিতে এসব দেশের অনুন্নয়ন ব্যাখ্যায় এই তত্ত্বটি অনন্য অবদান রাখে। তবুও এই তত্ত্ব সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে নয়। এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রধান প্রধান সমালোচনা নিম্নরূপ

১) সরল ও একমুখী

 ঔপনিবেশিক শাসন আমলে পুঁজিবাদী দেশগুলো প্রান্তের দেশ থেকে উদ্বৃত্ত পাচার করেছে এবং পরবর্তীতে ভিন্নতর কৌশলে এ ধারা অব্যহত রেখেছে এই বক্তব্য অভিমত সহজ-সরল ও একমুখী। কেননা উদ্বৃত্ত পাচারই উন্নয়নের একমাত্র উপাদান হতে পারে না।

২) কেন্দ্র ও প্রান্তের নির্ভরশীলতার মানদন্ড

 পৃথিবীর এক ধরনের দেশ নির্ভরশীল এবং অন্য ধরনের দেশ নির্ভরশীল নয় এমন একটি ধারনার উপর নির্ভরশীলতা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এমন দুই ধরনের দেশের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন। কারণ স্বাধীনতা ও নির্ভরশীলতা পরিমাপের মানদন্ড নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। বাস্তবে, বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পৃথিবীতে প্রায় সকল দেশই পরস্পরের উপর নির্ভরশীল।

৩) বিশেষ দেশ বা অঞ্চলভিত্তিক তত্ত্ব

এ তত্ত্ব কেবল ল্যাটিন আমেরিকার ক্ষেত্রেই অধিক প্রয়োগযোগ্য। কিন্তু কানাডা, ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক শাসনে থাকা সত্ত্বেও উন্নয়ন সাধন করেছে।

৪) উন্নয়নে অভ্যন্তরীণ উপাদানের গুরুত্ব উহ্য

উন্নয়নের জন্য তাত্ত্বিকরা বাহ্যিক উপাদান তথা উন্নত দেশের উপর নির্ভরশীলতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে উন্নয়নের জন্য অভ্যন্তরীণ উপাদান সমূহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা এই তত্ত্বে অবহেলিত রয়েছে।

৫) অর্থনীতির উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব

নির্ভরশীলতা তাত্ত্বিক অর্থনীতির ওপর এরূপ মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্বারোপের ফলে অ-অর্থনৈতিক উপাদানসমূহ অবহেলিত হয়েছে। বিশেষ করে রাজনীতির মতে, প্রভাবশালী উপাদান এই তত্ত্ব গুরুত্ব পায়নি।

৬) শ্রেনী বিশ্লেষণ অনুপস্থিত

এ তত্ত্বে শ্রেনী বিশ্লেষণ এড়িয়ে গেছেন। অসম উন্নয়নের সাথে শ্রেনীর প্রশ্নটি গভীর ভাবে জড়িত।

৭) উন্নয়নের কোন সুপারিশ নাই

নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত হয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো কিভাবে উন্নয়ন অর্জন করতে পারে এ ব্যাপারে সর্বসম্মত ও কার্যকর ব্যবস্থার সুপারিশ নির্ভরশীলতা তত্ত্বে অনুপস্থিত।

 

No comments

Powered by Blogger.