বিশ্বায়ন কী | গণমাধ্যম ও বিশ্বায়নের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক
বিশ্বায়ন কী ? গণমাধ্যম ও বিশ্বায়নের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক
তথ্যবিপ্লব এবং অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানের হাতে যে ভয়ংকর শক্তি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে তার ফলে এক নতুন সাম্রাজ্য গড়ে উঠছে। এই সাম্রাজ্য আমাদের মূল্যবোধ, জীবনধারা, প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতি সবকিছুই বদলে দিচ্ছে বিশ্বায়ন এত দ্রুত আমারে পরিচিত জগতকে এবং আমাদের সমাজ জীবনকে বদলে দিচ্ছে যে এই বহুদিক প্রসারিত পরিবর্তনকে অনুধাবন করা সত্যই কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিশ্বায়নের একটি অন্যতম দিক হচ্ছে গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রসার। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের ফলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি উন্নয়নশীল সমাজে বিস্তার করছে। এর ফলে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অপাশ্চাত্য সংস্কৃতির মধ্যে দ্বন্দেও সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্বায়ন হলো বিশ্বব্যাপী একমাত্রিক রাজনীতি, একমাত্রিক অর্থনীতি ও একমাত্রিক সংস্কৃতির অবাধ বিস্তার। গণমাধ্যের বিশ্বায়ন একমাত্রিক রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির বিস্তার ও সম্প্রসারণকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেয়। উপনিবেশদের ফলে যে পুজিবাদদের বিকাশ তা থেকে পুজিপাতিরা গণমাধ্যমের উপর মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় সীমানা অতিক্রম করে যে প্রভাব কলয় বাড়িয়ে তুলছে তাতে গণমাধ্যমেরই বিশ্বায়ন হচ্ছে।
বিশ্বায়ন
ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও বিশ্বায়নের অর্থ যে স্পষ্ট তা নয়। প্রত্যয়টির অর্থ নিয়ে
তাত্ত্বিকদের মধ্যে কোন ঐক্যমত নেই। বিশ্বায়নের প্রধান তাত্ত্বিক রোনাল্ড রবার্টসন একে অভিহিত করেছেন বিশ্বেও সংকোচন এবং পরস্পর নির্ভরশীলতা । একইভাবে মার্টিন আলব্রো বলতে চেয়েছেন বিশ্বায়ন হলো একটি কমিউনিটির মধ্যে সমস্ত মানুষকে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া।
বিশ্বায়ন সম্পর্কে ম্যাকগ্রু, বলেছেন বিশ্বায়নকে বলা যায় আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থার অনুগত বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং সমাজের মধ্যে বহুবিধ সংযোগ এবং সম্পর্কের নির্মিতিকে। অর্থাৎ, বিশ্বায়ন সারা বিশ্বজুড়ে একই ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং একই সাংস্কৃতিক নকশা তৈরী করে দিচ্ছে। দুর্বল করে দিচ্ছে জাতি রাষ্ট্রকে এবং পশ্চিমের রূপ পরিগ্রহ করছে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি, নেপলিয়ানের মহাদেশীয় ব্যবস্থা আর আমেরিকার রুজবেল্টের মুক্ত রজানীতির মধ্যে যে আধিপত্যবারে স্বপ্ন ছিল তার সম্প্রসারিত রূপ হলো আধুনিক বিশ্বায়ন।
Know More….গণমাধ্যম এবং সংস্কৃতি সাম্রাজ্যবাদ Media and Cultural Imperialism
বিশ্বায়নের বৈশিষ্ট্য :
Ian Clark বিশ্বায়নের চারটি বৈশিষ্টের কথা বলেছেন। যথা-
১. ভৌগলিক অবস্থানের উর্ধ্বে সামাজিক নতুন বিন্যাস যার মাধ্যমে দূরের মানুষের সাথে তাৎক্ষনিক যোগাযোগ এবং সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব। এই সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে ক্ষমতার নতুন বিন্যাস ও তৈরী হচ্ছে।
২. বিশ্বে সামাজিক সম্পর্ক এবং বিনিময়ের প্রাপ্তি, গভীরতা, গতি এবং প্রভাব ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৩. নতুন নতুন নেটওয়ার্ক এবং যোগাযোগের গ্রন্থী সৃষ্টি হচ্ছে। এটি ক্রমশ যোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে।
৪. বিশ্বায়ন দ্বিমুখী প্রক্রিয়া প্রথমটি হচ্ছে বিশ্বমুখীনতা যার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন সমাজ , প্রতিষ্ঠান পদ্ধতি অসমরূপ ধারন করে। অন্যটি হচ্ছে স্থানিকতা যার মাধ্যমে প্রান্তিক সমাজ , প্রতিষ্ঠান এবং সংস্কৃতি গুরুত্ব অর্জন করে এবং শক্তিশালী হয়।
বিশ্বায়নের কারণ
সামরিক কায়দায় ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বিশ্বায়ন কার্যক্রমের যাত্রা শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের প্রক্রিয়ায় বিশ্বায়নের কার্যক্রম বাড়তে থাকে। মূলত বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার কারণ হিসাবে চারটি কারণ উল্লেখ করা যায়। যথা-
১. যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকাশ : বিশ্বকে যুক্ত করার প্রথম প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ঔপনিবেশিক যুগের প্রথম দিকে সারা ুনিয়া জুড়ে টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপনের মাধ্যমে।
তারপর থেকে পৃথিবী ছোট হয়ে আসতে থাকে। পঞ্চাশেরশক থেকে প্রথম ট্রনজিস্টর রেডিও এবং পওে টিভি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে যোগাযোগের সেতুবন্ধন তৈরী করে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কম্পিউটারের উদ্ভাবন ঘটে এবং মাত্র ত্রিশ বছর আগে ১৯৬৯ সালে শুরু হয় ইন্টারনেট।
২. বহুজাতিক সংস্থা : ব্যক্তিগত মালিকানা নীতির বিকাশ বহুজাতিক কোম্পানির উদ্ভব হয়। বহুজাতিক সংস্থা তাদেও প্রযুক্তি এবং ব্যবস্থা কৌশল এক দেশ থেকে অন্য দেশে বিস্তৃত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মার্কিন বহুজাতিক সংস্থা ইউরোপে উৎপাদন শুরু করে। একই সময়ে জাপানী সংস্থাগুলো ক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় উৎপান শুরু করে। এভাবে বহুজাতিক সংস্থা অর্থনৈতিক একীভুবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩. সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন : সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন হয়েছে প্রাকৃতিক ব্যবস্থায়।
৪. পরিবেশগত বিপর্যয় : বিশ্বায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে পরিবেশগত বিপর্যয়। পরিবেশের সংকট এবং মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয় এক নতুন চেতনা সৃষ্টি করেছে। এটি হচ্ছে ‘সাধারণ নিয়তি চেতনা’।
বিশ্বায়ন ও গণমাধ্যমের আন্তঃসম্পর্ক :
ঔপনিবেশিক শোষণ আর বিশ্বায়নের মিথস্ক্রিয়া এবং উপনিবেশবাদীকে পুজিবাদের বিকাশে কোম্পানির উদ্ভব হয়। প্রযুক্তির বিকাশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে বহুজাতিক কোম্পানি পুজি আর প্রযুক্তির দাপটে প্রাকৃতিক সম্পরে উপর যেমন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয় তেমনি যোগাযোগ ব্যবস্থার উপরও আধিপত্য স্থাপনে সফলতা অর্জন করে।
১৯৬০ সাল থেকে যোগাযোগ স্যাটেলাইট বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের উপর বিস্তার ঘটাতে থাকলে তথ্য আদান-প্রদান আর সাংস্কৃতিক সঞ্চালনের ক্ষেত্রে ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিশ্বায়ন কার্যক্রমে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট এবং ক্যাবল টিভি একযোগে কাজ করছে।
গণমানুষ পারস্পরিক সম্পর্ক চর্চা আর সাংস্কৃতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যোগাযোগ প্রযুক্তি আর যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নির্ভরশীল হচ্ছে। যোগাযোগ এবং যোগাযোগ প্রযুক্তি ইউরোপ আমেরিকার প্রভাবশালী কর্পোরেট ফার্মগুলোর ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী চলতে থাকে।
ড্যানিয়েল লার্নার তার তত্ত্বে দেখান যে,গণমাধ্যম আধুনিক ব্যবস্থায় মানুষের চিন্তা ও যুক্তিশীলতার প্রসার ও বিস্তার বাড়িয়ে তুলছে। মার্শাল ম্যাকলুহান দেখান, প্রিন্ট মিডিয়া চিন্তা ও যুক্তিকে প্রাধান্য দিলেও টিভি চিন্তা যুক্তির চর্চাকে গুরুত্বহীন করে ইন্দ্রিয় নির্ভরতা বাড়িয়ে দেয়।
টিভি মানুষের গতানুগতিক ধারণা ও চেতনা এমনকি আদর্শিক চেতনা হারিয়ে বিশ্বগ্রামের সদস্য হওয়ার আহব্বান জানায়। গণমাধ্যমের বিশ্বায়নের ফলে গণমাধ্যম ও বিশ্বায়নের যে আন্তঃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা প্রধানত তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। যথা-
১. নির্ভরশীলতার সূত্র প্রয়োগ
২. মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ
৩. একমাত্রিক সংস্কৃতির বিস্তার
নির্ভরশীলতার সূত্র প্রয়োগ
উপনিবেশবাদে যে নির্ভরশীলতা আর আজকের বিশ্বায়নের যুগে যে নির্ভরশীলতা তা একই সূত্রে গাঁথা। অর্থাৎ- বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠায় যে উপাদানগুলো সক্রিয়া ভূমিকা রাখে তা হলো-
১. প্রযুক্তি
২. পুজি
৩. যোগাযোগ
যে নীতিতে প্রযুক্তি, পুজি আর যোগাযোগের ব্যবহার করা হয় তাহলো নির্ভরশীলতার নীতি।
গণমাধ্যম কেন্দ্রের সংস্কৃতি বিস্তারের ক্ষেত্রে বিশ্বায়নকে ব্যবহার করছে। প্রযুক্তির উন্নয়নে ক্যাবল নেটওয়ার্ক, স্যাটেলাইট চ্যানেল, কম্পিউটার, ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক তৈরী হয় তার ফলে কেন্দ্রের সংস্কৃতির বিশ্বায়ন কার্যক্রম চলতে থাকে।
তথ্যের জন্য, সংবাদের জন্য, সংস্কৃতির জন্য গণমাধ্যমের উপর নির্ভরশীলতা পুজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও সূূর করে তুলতে সক্ষম হয়। এর ফলে সংস্কৃতি কেন্দ্রমুখী হয়ে পড়েছে। বিশ্বায়ন নির্ভরশীলতার এক সম্প্রসারিত জাল। কর্পোরেট গণমাধ্যম শিল্পের উৎপাতি পণ্য আর কোম্পানি উৎপাদিত সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত করে চলছে। যার ফলে নির্ভরশীলতা ব্যাপকতা লাভ করে।
মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ
মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ ভৌগলিক সাম্রাজ্যবাদেরই পরবর্তী পর্যায়। গণমাধ্যম নেটওয়ার্কের ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে সরাসরি জনগণের ঘরে পৌছে। আমেরিকাভিত্তিক গণমাধ্যম কর্পোরেশন যেমন- টাইম ওয়ার্নার, ডিজনি ভায়াকম বিশ্বব্যাপী মিডিয়া সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলছে।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠছে প্রভাব বিস্তারকারী কর্পোরেট গণমাধ্যম সংস্থা যারা পারস্পরিকভাবে বিশ্বের সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে।
কর্পোরেট গণমাধ্যম রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে খন্ড বিখন্ড করে দিতে পারে।
প্রভাবশালী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত বহুজাতিক গণমাধ্যম সংস্থা স্বাধীন সংস্থা রূপে অনুগত রাষ্ট্রগুলোর অধিবাসীদের উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখে। অনুগত রাষ্ট্রগুলোর অন্তর্ভুক্ত সংস্থার ক্ষমতা দুর্বল হতে থাকে। জাতীয় চেতনা কর্পোরেট চেতনায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
কর্পোরেট গণমাধ্যম ফার্মগুলো অতি আধুনিক ব্যয়বহুল প্রযুক্তির ব্যবহারে সংগীত, খেলাধুলা, ফিল্ম ও আরো বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মালার উপর ভিন্ন ভিন্ন নামের চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করে সাংস্কৃতিক রূপান্তরের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে।
আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক যোগাযোগের অধ্যাপক C.T. Hamclink বিশ্বগণমাধ্যমের বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের যে চিত্র তুলে ধরেছেন সেখানে বিশ্বযোগাযোগে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা হুমকির মুখে। আমেরিকার সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলপ্রসু অত্যাধুনিক অস্ত্র গণমাধ্যম। তিনি বলেন, সাংস্কৃতিক প্রভাব সৃষ্টি করতে গণমাধ্যম কতগুলো প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে কাজ করছে। যেমন-
১. আন্তর্জাতিক সংবাদ এজেন্সী
২. আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপণ এজেন্সী
৩. আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের জনমত ও গণসম্পর্ক প্রতিষ্ঠান
৪. ট্রান্সন্যশনাল ব্যবসায়িক সংস্থা
৫. যোগাযোগ প্রযুক্তি ও সহায়ক যন্ত্রপাতির রপ্তানি
অত্যাধুনিক যোগাযোগ স্যাটেলাইট প্রতিষ্ঠার ফলে মূহুর্তেই বিশ্বের তথ্য কেন্দ্রীভূত হয়। বহুজাতিক সংস্থা তথ্যের মালিক হয়ে যায়। IBM এর মত তথ্যব্যাংক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তথ্যের উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়।
প্রতিটি দেশের আলাদা আলাদা সংবাদ সংস্থা থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংবাদপত্র, টিভি স্ব-স্ব দেশের সংবাদ সংস্থার চেয়ে গুচ্ছ সংবাদ সংস্থায় (অচ, ইইঈ, অঋচ, জবঁঃবৎং) তথ্যও সংবাদকে অধিকতর গুরুত্ব সহকারে প্রচার করে। প্রভাবশালী গুচ্ছ সংবাদ সংস্থাগুলো তথ্যও সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে নিজেদের আনুকূল্য ও সমর্থন প্রত্যাশা করে। তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী তথ্য ও সংবাদের ধরন, প্রকৃতি সনাক্ত করা হয়।
মুনাফাধর্মী কর্পোরেট সংস্কৃতির বৈশ্বিক অনুপ্রবেশ ও প্রভাবে কর্পোরেশনগুলোর খলারিত্ব কায়েম হয়েছে। তাই বলা হয়- আজকের যুগ হল তরল উপনিবেশবাদের যুগ।
গণমাধ্যমের বিশ্বায়ন ও একমাত্রিক সংস্কৃতি :
গণমাধ্যমের বিশ্বায়ন একমাত্রিক সংস্কৃতির উপর সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেয়। গণমাধ্যম প্রত্যক্ষভাবে সংস্কৃতি বিশ্বায়নে নেতৃত্ব দিয়ে আসলেও অর্থনীতি ও রাজনীতির বিশ্বায়নে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে।
হার্বাট মারকুজ তার একমাত্রিক মানুষ তাত্ত্বে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন যে, শিল্পোন্নত সমাজে মানুষের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও ধ্যান-ধারণা একমাত্রিক আকার ধারণ করায় প্রতিটি ব্যক্তি একমাত্রিক হয়ে পড়েছে।
শিল্পোন্নত সমাজের প্রতিটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি যেমন একমাত্রিক তেমনি গণমাধ্যমের সংস্কৃতির যৌক্তিকরণের মধ্যে দিয়ে একমাত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত যৌক্তিকতা গণমাধ্যমের সংস্কৃতির প্রতি মানুষের আবেগ বাড়িয়ে তুলছে।
গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ যেমন গণমানুষের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য ও সত্য বলে প্রভাবিত হয়। গণমাধ্যমের অনুষ্ঠানও তেমনি জীবন ও সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হয়ে যায়। কর্পোরেট গণমাধ্যম সর্বপ্রথম শিল্পোন্নত দেশগুলোতে একমাত্রিক সংস্কৃতির বিস্তার ঘটায়, পরে নির্ভরশীল ও গণমাধ্যম সাম্রাজ্যবাদে আক্রান্ত দেশগুলো এই একমাত্রিক সংস্কৃতির স্থানান্তর ঘটায়।
গণমাধ্যম সংস্কৃতিকে আনন্দনির্ভর, বিনোদনমুখী করে বাজারে ছেড়ে দেয় যা প্রতিটি ব্যক্তির সাধারণ প্রবৃত্তিকে অতিউৎসাহী করে তোলে। ইউরোপ আমেরিকার কর্পোরেট গণমাধ্যম কর্তৃক নির্ধারিত সংস্কৃতি পাশ্চাত্য সংস্কৃতিরূপে বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হয়েছে। গণমাধ্যমের সংজ্ঞাটি বিশ্বায়নের নামে জাতীয় পরিচয়কে যেমন ভুলিয়ে দেয় তেমনি একমাত্রিক সংস্কৃতিকে বৈশ্বিক সংস্কৃতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে।
কর্পোরেট গণমাধ্যম যখন জাতীয় গণমাধ্যমের উপর প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয় তখন কর্পোরেট গণমাধ্যম জাতীয় চেতনাকে প্রান্তিক করে ব্যক্তির কামনা-বাসনা নির্ভর সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নির্মাণকে অগ্রাধিকার দেয়।
নগরের ঘরে ঘরে টিভি পৌছে গেলে শিল্পোন্নত সমাজের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র একমুখী কর্পোরেট সংস্কৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করে। যার ফলে আজকের যুগে গণমাধ্যমের বিশ্বায়ন কার্যক্রম ভৌগলিক সীমানা অক্ষুন্ন রেখেই প্রতিটি জাতির চেতনা ও সংস্কৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করেই চলেছে, যা একমাত্রিক সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দিক হতে গণমাধ্যম জাতীয় পর্যায় থেকে বৈশ্বি পর্যায়ে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা অর্জন করে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বৈশ্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণের মধ্যে দিয়ে বাজার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়।
বৈশ্বিক গণমাধ্যম বাজার বিশ্বের সর্ববৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আমেরিকা, ইউরোপের ফার্মগুলো শুধু নিজেদের দেশগুলোতে নয়, এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে তাদের প্রভাব বয়ে আনার ক্ষেত্রে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে গণমাধ্যম বিশ্বায়নের কারণে।
গণমাধ্যমের বিশ্বায়নে সংস্কৃতির একীভূতকরণ পদ্ধতি কার্যকর করার পেছনে যে বিষয়টি কাজ করে তাহলো গণমাধ্যম মালিকানার ক্ষেত্রে ইউরোপ, আমেরিকার বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য। বৈশ্বিক গণমাধ্যমের একীভূতকরণের ফলে মালিকানাই শুধু কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছেনা ,
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির উপর একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। একুশ শতাব্দীতে বৈশ্বিক গণমাধ্যমগুলো গণমাধ্যম ব্যবস্থার জাতীয় পর্যায় অতিক্রম করে বাণিজ্যিক গণমাধ্যমরূপে আবির্ভূত হয়েছে।
No comments