মিডিয়া কি | মিডিয়া ও ক্ষমতা র মিথোজীবিতা গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যে সহায়ক নাকি হুমকি

মিডিয়া কি ? মিডিয়া ও ক্ষমতা র মিথোজীবিতা গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যে সহায়ক নাকি হুমকি ব্যাখ্যা কর

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সংবাদের উপর বিজ্ঞাপন দাতাদের প্রভাব

”সত্যজিত রায়ের” হীরক রাজার দেশে ছবিটির গল্প দিয়ে আমরা শুরু করতে পারি। ছবিটিতে দেখা যায়, রাজার একক আধিপত্য দেশজুড়ে। তার অনুগত মন্ত্রী ও শাস্ত্র বহর আছে। হিরক রাজ্যের রাজা কাউকে প্রানে মারেন না, কারাগারে প্রেরন করেন না, কিংবা দেশান্তরীও করেন না। তিনি আবিষ্কার করেছেন এক বিস্ময়কর ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র’ । যন্ত্রটি যে ঘরে রাখা থাকে তার নাম ’যন্তরমন্তর ঘর’ ।

খাজনা দিতে অস্বীকারকারী কৃষক, হীরার খনিতে কাজ করা অসন্তুষ্ট শ্রমিক, আর দেহে প্রান আছে গান গায় ‘জীবনের গান’, ‘শান্তিপূর্ণ গান’, শাসনের অন্তরায় এমনসব বেয়াড়া নাখোশ লোকদের সাইজ করার জন্যেই , তাদের ধরে এনে যন্তরমন্তর ঘরে পুরে দেন। তখনই ঘটে ভেল্কিভাজি। মগজধোলাইকৃত ব্যক্তি রাজার শেখানো বুলি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না। “ভরপেট নাও খাই, রাজাকে দেয়া চাই। বাকি রাখা খাজনা মোটে ভাল কাজ না। যায় যদি যাক প্রান, হিরকের রাজা ভগবান।”

হীরকের রাজা যে ক্ষমতা কাঠামোর আশ্রয়ে থেকে তাঁর কর্তৃত্ব ফলান তা এক কথায় অগনতান্ত্রিক, সৈরতান্ত্রিক। বর্তমানে গণতান্ত্রিক সমাজগুলোতে বিরাজমান ক্ষমতা কাঠামো তেমন নয়। তথাপি আজকের সমাজ ও শ্রেনীবিভক্ত ও স্তরায়িত।

এই ক্ষমতা কাঠামো শীর্ষে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের স্বার্থ রক্ষা করে চলে। জনগনের হাত শক্তিশালী করতে হলে, সেই ক্ষমতা সম্পর্ক এবং এই ক্ষমতা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করা মহাদর্শিক বাহনকে চিনে নেওয়া জরুরি। নচেৎ, ফজল মিয়াদের মতোই রাজাদের শেখানো বুলিই আওড়াতে হবে তোতাপাখির মতো।

মিডিয়া কি:মিডিয়া ও ক্ষমতা

মিডিয়া হচ্ছে জনগনকে তথ্য জানানোর মাধ্যম তথা বাহন। তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমরা মিডিয়ার উপর নির্ভর থাকি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে মিডিয়া আমাদের কোন ধরনের তথ্য দিচ্ছে? মিডিয়া সংবাদের মাধ্যমে কোন শ্রেনীর স্বার্থ বাস্তবায়নের চেষ্টা করে? মিডিয়া জনগনের বন্ধু হবে, তবে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদটিই প্রচার করবে।

 গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নিরপেক্ষ সংবাদটি মিডিয়া জনগনের কাছে পৌঁছে দেবে এমনটাই কাম্য। কিন্তু মিডিয়া যখন বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর দালালি করে, গনতন্ত্রের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ সেখানেই বাধাগ্রস্ত হয়। তাই মিডিয়া হতে হবে জনগনের কন্ঠসর। জনগনই এখানে প্রাধান্য পাবে। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যমে মিডিয়াকে তার নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চত করতে হবে।






মিডিয়ার ক্ষমতা : মিডিয়া ও ক্ষমতা

ক্ষমতা মূলত এক সম্পর্কের নাম। কোন ব্যক্তির ক্ষমতা আছে কি না তা বোঝা যাবে, যখন সেই ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে এমন কিছু কাজ করতে বাধ্য করতে পারে যা সেই ব্যক্তি সেচ্ছায় করত না। অর্থাৎ ক্ষমতা হল এক ধরনের দক্ষতা বা প্রভাব যা অন্যের উপর প্রযুক্ত হয়। অন্যের অস্তিত্ব কে প্রভাবিত করতে সমর্থ হলে তবেই কারোর ক্ষমতার অস্তিত্ব প্রমানিত হয়। এমিল ডুর্থেইস এ কারনেই বলেছেন, ” সমাজই ব্যক্তিকে উৎকৃষ্ট কিংবা নিকৃষ্ট, আদেশ দানকারী কর্তা ও পালনকারী ভৃত্য শ্রেনীতে বিন্যস্ত করে, সমাজই কর্তাব্যক্তিদের সবসময় সম্পদ দান করে যা তাদের নির্দেশকে ফলপ্রসূ করে তোলে যা ক্ষমতাকেই নির্মান করে।

ক্ষমতা ধারনাটিকে আমরা দুই ভাগে ব্যাখ্যা করতে পারি। একদিকে রয়েছে অসম ক্ষমতার ধারনা, যেখানে সংঘাত ও প্রতিরোধের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করা হয়। ক্ষমতার এই প্রকার ধারনায় ধরে নেওয়া হয় যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক প্রতিযোগিতা মূলক এবং মূল্যগত ভাবেই দ্বান্দ্বিক, কারন এক ব্যক্তির ক্ষমতা অন্যের ক্ষমতার প্রভাবকে বাধাগ্রস্ত ও ব্যবহৃত করে। অন্যদিকে, ক্ষমতার ভিন্ন রকম ধারনাটি মনে করা হয়, একজনের প্রাপ্তি মানে এই নয় যে সেটা অন্যের ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে ঘটবে বরং সকলেই একই সাথে অর্জনের অংশীদার হতে পারে। ক্ষমতার ধরনের ধারনা সংহতিপূর্ণ ও সাম্যমূলক সামাজিক বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভংঙ্গির ওপর ভিত্তিশীল বলে মনে হয়, তবে এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতির যুগে অচল।

আজকের সমাজে ক্ষমতা কার হাতে কেন্দ্রীভূত? ক্ষমতা প্রসঙ্গে সাড়া জাগানো তাত্ত্বিক মিশেল যুগে বলেছেন, ক্ষমতা প্রথাগতভাবেই অন্তত ইউরোপীয় সমাজে মনে করা হয় যে, ক্ষমতা সরকারের হাতে কেন্দ্রীয়ভূত এবং এর চর্চা করা হয় নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন- প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং সরকারের অন্যান্য শাখার মাধ্যমে। আমরাজানি, সরকারের এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়, জাতি ও রাষ্ট্রের নাম করে। নির্দিষ্ট কিছু সিদ্ধান্তের বিস্তারও বাস্তবায়নের জন্য এবং যারা এ সিদ্ধান্ত অমান্য করে তাদের শাস্তি দেয়ার জন্য।

মিডিয়া প্রতিনিয়ত হাজারো রকম তথ্য, বিনোদন, মতামত, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি প্রকাশ করছে, জনগনের মগজে প্রবেশ করছে। এখন, মিশেল ফুকোর বিশ্লেষন থেকে আমরা এ উপসংহারে আসতে পারি যে, মিডিয়াগুলো যে নিরপেক্ষতার কথা অহরহ বলে এবং জনগনের পক্ষে থাকার যে দোহাই দেয় তা ঠিক না। মিডিয়া অতি অবশ্যই শ্রেনী নির্ভরশীল, মিডিয়া অতি অবশ্যই রাজনৈতিক ভূমিকা আছে এবং আধিপত্যশীল ধারার মিডিয়া সমাজের ক্ষমতাশীল শ্রেনীর মতাদর্শনকেই বহন করে চলেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগী হয়ে আধিপত্যশীল ধারার মিডিয়া আপামর জনসাধারনের ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের’ করে ক্ষমতাবান শ্রেনীর পক্ষে নিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মিডিয়ার ক্ষমতা আলোচনা করলে, আমরা বলতে পারি, মিডিয়া তার নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারে অত্যন্ত সুচতুর এবং সুকৌশলে মিডিয়া একদিকে যেমন কোন ব্যক্তিকে হিরো বানাতে পারে অন্যদিকে তেমনি জিরোও করতে পারে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে বিশেষ করে কোন ব্যক্তিকে মিডিয়া চাইলে তুলোধুনা দিতে পারে হোক সেটা রাজনৈতিক আক্রমন কিংবা তার অন্যায়ের শাস্তি।

মিডিয়া চাইলে দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে পারে এবং সাম্রাজ্যবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধ করতে পারে। এক্ষেত্রে মিডিয়াকে উন্নতমানের অনুষ্ঠান উপহার দিতে হবে। মিডিয়া সমাজের সংস্কারমূলক কাজ করতে পারে। ব্যক্তি মানসিকতার উন্নতি সাধনে সহায়তা করতে পারে। মিডিয়া চাইলে দেশকে বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে আবার রক্ষাও করতে পারে। মিডিয়া রাষ্ট্রকে সংশোধন করতে পারে।

মিডিয়া ক্ষমতা কাঠামোর বিশ্লেষন করলে আমরা দেখি ‍মিডিয়া মূলত পুঁজিতন্ত্র তথা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বার্থ বাস্তবায়নের চেষ্টা করে কিন্তু সাধারন জনগনকে এখানো কোন পাত্তাই দেয়া হয় না। অর্থাৎ সাধারন জনগন মিডিয়ায় উপেক্ষিত।

গনতন্ত্রের সাথে মিডিয়ার সম্পর্ক: মিডিয়া ও ক্ষমতা

গনতন্ত্রের সাথে মিডিয়ার সম্পর্ক অত্যন্ত আন্তঃ নির্ভরশীল সম্পর্ক। মিডিয়া গনতন্ত্রের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।

মিডিয়ার কাজ হচ্ছে জন গনকে তথ্য জানানো। আর গনতান্ত্রিক সিস্টেমে মিডিয়া তথা তথ্যের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ যাতে বাধাগ্রস্থ না হয় সেটি নিশ্চিত করা গনতান্ত্রিক সরকারের কাজ। মিডিয়াকে বলা হয় জাতির বিবেক, রাষ্ট্র চতুর্থ স্তম্ভ। তাই মিডিয়া গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর মূলভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। সমাজের স্বার্থে মিডিয়া কাজ করবে এবং রাষ্ট্রকে সংশোধন করা মিডিয়ার কাজ।

বর্তমানে গোটা বিশ্বব্যবস্থায় গনতন্ত্রের জয়জয়কার। যদিও কেউ কেউ বলেন গনতন্ত্র হল মুর্খদের শাসন তথাপি গোটা বিশ্বে আমরা দেখি গনতন্ত্র চর্চার মূলভিত্তি হিসেবে মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয়। তাই সামগ্রিক দৃষ্টিকোন থেকে আমরা বলতে পারি মিডিয়া ছাড়া গনতন্ত্র অচল। মিডিয়া যেহেতু রাষ্ট্রের ওয়াচডগের ভূমিকা পালন করে সেহেতু মিডিয়ার উপস্থিতি ছাড়া গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কথা কল্পনাও করা যায় না। তাই বলা যায়, মিডিয়া এবং গনতন্ত্রকে একে অপরের পরিপূরক।

গনতন্ত্রের জন্য সহায়ক নাকি হুমকি:মিডিয়া ও ক্ষমতা

মিডিয়াকে বলা হয় গনতন্ত্রের যোগ্য অংশীদার। মিডিয়া না থাকলে গনতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে। মিডিয়া গনতন্ত্রকে সহায়তা করে। মুক্ত বুদ্ধির চর্চার জন্য মিডিয়া দরকার, যা গনতন্ত্রের মূল ভিত্তি। এককথায় বলতে পারি মিডিয়া এবংগনতন্ত্র একে অপরের সঙ্গী।

মিডিয়ার স্বাধীনতা যেমন গনতন্ত্রের জন্য জরুরী তেমনি মিডিয়ার অতিরিক্ত স্বাধীনতা কখনো কখনো গনতন্ত্রের জন্য শুভ হয় না। তখন মিডিয়া রাষ্ট্রের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। তাই মিডিয়ার ক্ষমতা হওয়া উচিৎ গনতন্ত্রের সুষ্ঠ বিকাশের স্বার্থে; কোন গোষ্ঠী, দল কিংবা মহলের তাঁবেদারি করার জন্য নয়।

বর্তমান সমাজ কতটা গনতান্ত্রিক: মিডিয়া ও ক্ষমতা

নোয়াম চমস্কি বলেছেন, কাম্য গনতন্ত্রের ধারনা এ সমাজে অনুপস্থিত। মিশেল ফুকো বলেছেন, ”গনতন্ত্র বলতে কেউ যদি একটি জন সমষ্টি কর্তৃক ফলপ্রসূ ক্ষমতার চর্চা বলে মনে করে। যে জনসমষ্টি বিক্ষিপ্ত নয় কিংবা ক্রমতান্ত্রিকভাবে শ্রেনীবিভক্ত নয়; তবে এটা খুব স্পষ্ট যে, আমরা গনতন্ত্র থেকে বহুদূরে অবস্থান করছি। এটা খুবই স্পষ্ট যে, আমরা বাস করছি একটি শ্রেনী একনায়কতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর অধীনে, শ্রেনীর ক্ষমতার অধীনে; যে শ্রেনী নিজেকে অধিষ্ঠিত করে সহিংসতার মাধ্যমে যদিও হতে পারে যে; সহিংসতার হাতিয়ারগুলো হলো প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংবিধানিক।”

বিরাজমান ‘গনতন্ত্রে’ ক্ষমতার বন্টন অসম ও শোষনমূলক। ‘গনতন্ত্র’ এই পদটিকে যদি আমরা তার সঠিক অর্থে চিন্তা করি তাহলে আমরা দেখব যথার্থ গনতন্ত্র কোথাও কখনো সৃষ্টি হয়নি এবং কখনো কোথাও সৃষ্টি হবেও না। তবু একটা কাম্য গনতন্ত্রের আকাঙ্খা, যেখানে জনগনের অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষিত হবে, শোষনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংশ প্রাপ্ত হবে, মানুষ তার সম্পূর্ন স্বাধীনতা নিয়ে বিকশিত হবে, সৃজনশীলতা চর্চার পূর্ন সুযোগ পাবে, আমাদের থেকেই যায় এবং সেই লক্ষ্যে জনগনের লড়াই চলছে।

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সংবাদের উপর বিজ্ঞাপন দাতাদের প্রভাব

মিডিয়ার মালিকানা ও ভূমিকা:মিডিয়া ও ক্ষমতা

মিডিয়া গবেষক রবার্ট ডব্লিউ ম্যাকচেজানি ১৯৯৭ সালে বলেন, একটা ভূত এখন সারা পৃথিবীকে তাড়া করছে; ক্ষুদ্র সংখ্যক মহাক্ষমতাধর বহুজাতিক মিডিয়া কর্পোরেশনের অধিপত্যাধীন, যার অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক, বৈশিক বাণিজ্যিক মিডিয়া সিস্টেম। এটি এমন একটা সিস্টেম যা বৈশিক বাজার গড়ে তুলতে ও বাণিজ্যিক মূল্যবোধ প্রমোট করতে কাজ করে এবং একই সাথে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি কর্পোরেট স্বার্থের প্রতিকূল সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতির আনয়ন ঘটায়।

মিডিয়া কোম্পানিগুলো কর্পোরেশনগুলোর যৌথ উৎপাদনের ফলে বাজারে কোন প্রতিযোগিতা থাকে না এবং তাদের মুনাফা অর্জন হয় নির্বিঘ্ন, প্রভাবও পরে একচেটিয়া। ম্যাকচেজনি বলেন, পৃথিবীর বেশীরভাগ চলচ্চিত্র, টিভি-শো, কেবল চ্যানেল মালিকানা, কেবল ও স্যাটালাইট ব্যবস্থার মালিকানা, বই প্রকাশনা, ম্যাগাজিন প্রকাশনা, সংগীত শিল্প পঞ্চাশটির মতো ফার্মের নিয়ন্ত্রনে এবং প্রথম স্তরের নয়টি ফার্ম এই সকল ক্ষেত্রেই আধিপত্য করে। গনতন্ত্রের যেকোন মানদন্ডেই এই পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। এসব অধিপতি মিডিয়ার আকার ও আর্থিক সামর্থ বাড়ার সাথে সাথেই, ক্ষুদ্র মিডিয়া গুলোকে কিনে নিতে বা নিঃশেষ করে দিতে, তাদের দমন-পীড়নও বেড়ে গিয়েছে।

বৈশ্বিক মিডিয়ার সাথে সবটুকু না মিললেও আমরা দেখি , বৃহৎ পুজিঁর মালিকরাই মিডিয়া ব্যবসায় নামে। যেমন: বাংলাদেশের প্রধান দুইটি দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো ও যুগান্তর যথাক্রমে ট্রান্সকম লিমিটেড যমুনা গ্রূপের মালিকানাধীন। তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থই এক্ষেত্রে প্রাধান্য পায়, তারা যে মূল্যবোধের প্রসার ঘটায় তা বৈশ্বিক অধিপতি মিডিয়াগুলোর পক্ষেই চলে যায়।

মোটকথা আধিপত্যশীল মিডিয়া সংস্থাগুলো অনেক বড় আকারের ব্যবসায়ই ধনী ব্যক্তিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং কিংবা ব্যবস্থাপকরা নিয়নত্রন করে। এই মিডিয়া গুলো ঘনিষ্ঠভাবে আন্তঃসম্পর্কিত এবং অন্যান্য প্রধান কর্পোরেশন, ব্যাংক ও সরকারের সাথে তাদের গুরুত্বপূর্ন স্বার্থগত সম্পর্ক রয়েছে। এটা সংবাদ বাছাইকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। সাম্প্রতিক উদাহরন দিলে আমরা বলতে পারি, গত ৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনকে ঘিরে মিডিয়ার কার্যকর ভূমিকা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচন পরবর্তী বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতির পর মিডিয়া সেটাকে জায়েজ করে নেয়। এক্ষেত্রে অনেক বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারতো, যা গনতন্ত্রের পথকে আরো মসৃন করতো কিন্তু মিডিয়ার মালিকানা এবং স্বার্থগত বিষয় এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

মিডিয়ার সাথে বিজ্ঞাপনের সম্পর্ক :মিডিয়া ও ক্ষমতা

মিডিয়ার সাথে বিজ্ঞাপনের সম্পর্ক মা-বাপের সম্পর্কের মত। ম্যাকচেজানি মনে করেন, বৈশ্বিক মিডিয়া বাজার গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ইন্ধন যুগিয়েছে বৈশ্বিকভাবে বিজ্ঞাপনের প্রসার। ফার্মের স্বার্থরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিজ্ঞাপন। ১৯৯৫ সালের পৃথিবীর আটটি বৃহৎ বিজ্ঞাপনদাতা গোষ্ঠী তাদের মোট ব্যয় ৩০০ বিলিয়ন থেকে সারা বিশ্বে কেবল বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য খরচ করে ২৫ বিলিয়ন ডলার।

বিজ্ঞাপন দাতারাই মিডিয়ার প্রকৃত কাস্টমার। টার্গেট অডিয়ান্সকে লক্ষ্যকরেই টিভি স্টেশনগুলো তাদের অনুষ্ঠান মালা সংবাদ প্রচার করে, যাদেরকে বিজ্ঞাপনদাতারা পছন্দ করে। এদেশের ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করে তুলেছে মিডিয়া, কারন ক্রিকেটের সাথেই বেশী বিজ্ঞাপন যায়।

অধিপতি মিডিয়া অডিয়েন্সের কাছে বিপনন বার্তা প্রচারের মাধ্যম। এই অডিয়েন্স হলো সমাজের উচুঁতলার অডিয়েন্স; যাদেরকে মিডিয়া আপামর জনগন বলে চালিয়ে দেয়।

সংবাদ মানে ক্ষমতাশালীদের সংবাদ

মিডিয়া সমাজের উচ্চবৃত্ত তথা ক্ষমতাশালী শ্রেনীর প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯৯২ সালে মারকুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এক জরিপে দেখা গেছে ইংল্যান্ডের সম্পদকদের ৯৩ শতাংশ বলেন যে, বিজ্ঞাপনদাতারা তাদের সংবাদকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। দারিদ্যের দুর্বৃত্বায়ন নিয়ে পিটার গোল্ডিং ও সু মিডিলটন দীর্ঘদিন ধরে গবেষনা করে দেখিয়েছেন, “কল্যানমূলক পুঁজিবাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো যে, তা দারিদ্রের কখকখ কারন ও হালচাল প্রায় সম্পূর্ন ভেঙ্গে দেয়।

আমাদের দেশে দেখি রাস্তার সহিংসতার সংবাদ নিয়ে বিপুল কভারেজ দেয় মিডিয়া। কিন্তু ক্ষমতাশীলদের সহিংসতা কিংবা কর্পোরেট সহিংসতা খুব একটা ছাপা হয়না। কৌশলে এড়িয়ে যায়। শোষিত গার্মেন্টস কর্মীরা আগুনে পুড়লে মিডিয়া মানুষের আবেগের জায়গাগুলো পুঁজি করে ব্যবসা করে কিন্তু মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কেমন যেন নিরব থাকে।

মিডিয়ার বিরাজনীতিকরন:

মিডিয়ার আসল উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন। রাজনীতি মিডিয়ার খুব একটা ভালো লাগে না। গনতন্ত্রের আড়ালে সৈরতন্ত্র থাকলেও মিডিয়ার কিছু যায় আসে না। ধনী-দরিদ্র্যের ব্যবধান সৃষ্টি করতে পারলেই ব্যপক পুঁজির মালিক হওয়া যায়। জনগনকে রাজনীতি থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে শাসক শ্রেনীর অর্থনীতিকে যা ইচ্ছা তাই করছে। ম্যাকচেজনি বলেন, অর্থনীতি যতটুকু বিরাজনৈতিক করে তোলা যায়।

মিডিয়ার কাঠমো কতটা গনতান্ত্রিক:

মিডিয়া মালিকদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে মূল বিবেচ্য বিষয়। মিডিয়াগুলোতে কর্পোরেট অধিপত্য বেড়ে যাওয়ার অভ্যন্তরীন ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। মিডিয়া সাংবাধিনিক সুরক্ষার মাধ্যমে বাক ও ‘প্রেসের স্বাধীনতা’ ভোগ করে কিন্তু একই রকম স্বাধীনতা কর্মচারীদের দেয় না যা আদৌ গনতান্ত্রিক নয়।

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সাংবাদিকতা: মিডিয়া ও ক্ষমতা

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন, প্রচার-প্রসার হয় ইন্টারনেটের মাধ্যমে। ইন্টারনেটের কৃতিত্ব মার্কিন জনগনের পয়সায়-প্রচেষ্টায় পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও পেন্টাগনের। কিন্তু ইন্টারনেট এখন কর্পোরেট পুঁজির হাতের মোয়া এবং ইন্টারনেটকে ঘিরে একটি বিশাল বাজার তৈরী হয়েছে।

তবুও ইন্টারনেট এ কালের জনগনের সাহিত্য, সাংবাদিকতা এবং এই কালের কন্ঠস্বর। তৈরী হয়েছে নতুন সুযোগ। লড়াইয়ের নতুন চেহারা। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সাংবাদিকতা দিন দিন বিকাশিত হচ্ছে।

সাংবাদিকতা শিক্ষার কাঠামো শাসক শ্রেনীর প্রতিনিধিত্ব তৈরী করে:

সাংবাদিকরা মালিকের গোলাম মাত্র। মজুরীভোগী গোলাম। সংবাদপত্র ঠিকই একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মালিক পক্ষ দেখে শুনে কর্মচারী করেন নিজ স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। সাংবাদিকরা যেমন মালিকের কাছে দায়বদ্ধ তেমনি মিডিয়া মালিকরা ও তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে শাসক শ্রেনীর সাথে ‘গভীর সম্পর্ক’ জালে আবদ্ধ। সেই অর্থে মালিকরা শাসকশ্রেনীরই প্রতিনিধিত্ব করে।

সচেতনতার প্রসঙ্গে ‘হীরকরাজার দেশে’ চলচ্চিত্রের কথা দিয়ে শেষ করা যায়। যেখানে মস্তিস্ক প্রক্ষালন যন্ত্রের প্রভাবে সবাই বলে, “দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান”

No comments

Powered by Blogger.