বাংলাদেশে জনসংযোগ সমস্যা ও সমাধান । জনসংযোগ
বাংলাদেশে জনসংযোগ সমস্যা ও সমাধান
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আধুনিক জনসংযোগ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাত্রা শুরু করে । জনসংযোগের ইতিহাস আরো অনেক প্রাচীনকাল থেকেই শুরু হয়েছে । তবে তা বর্তমানের মতো সুসংহত রূপে ছিল না । মূলত , একই জিনিস ভিন্ন নামে ভিন্ন রূপে ছিল ।
বাংলাদেশের জনসংযোগের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে ধীরগতিতে । পাক-ভারত উপমহাদেশের বিভক্তির পর থেকে এদেশে জনসংযোগের পদযাত্রা শুরু হয় । তবে তা অবিভক্ত ভারতবর্ষের কাছে থেকে পাওয়া । তৎকালীন বাংলাদেশের সংগঠনগুলো সে উত্তরাধিকার নিয়েই জনসংযোগ শুরু করে । এক্ষেত্রে তৎকালীন সরকারের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখযোগ্য । সে সময় প্রতিটি প্রদেশে ডাইরেকটোরেট অফ পাবলিক রিলেশন খোলা হয় । এর পরিচালনার জন্য একজন করে পরিচালক নিয়োগ করা হয় ।
বিভিন্ন নির্দিষ্ট গ্রুপের সাথে যোগাযোগ রক্ষা এবং জনগণের কাছে সংস্থার অনুকূলে ভাবমূর্তি সৃষ্টি ও রক্ষা করার উদ্দেশ্যে অল্পসংখ্যক ব্যবস্থাপক ও কর্মকর্তা পঞ্চাশের দশকে জনসংযোগের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন । ফলে সরকারি ও বেসরকারি উভয় সেক্টরে সীমিত সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে জনসংযোগ বিভাগ খোলা হয় । পরে ধীরে ধীরে জনসংযোগ ইউনিট বাড়তে থাকে এবং স্বাধীনতার পর তা আরো কিছুটা বিস্তৃতি লাভ করে । ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে জনসংযোগ সমিতি প্রতিষ্ঠা করা হয় । নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এর সদস্য সংখ্যা ছিল ১৫০ ।
বাংলাদেশে জনসংযোগের বর্তমান অবস্থা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয় । আমাদের দেশে লোকজন এখনো জনসংযোগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে না । পায় নি প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা । অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে জনসংযোগ একটি প্রতিষ্ঠিত ও মর্যাদাপূর্ণ পেশা হিসেবে স্বীকৃত । ১৯৭৮ সালে এ দেশে দেশে প্রতিষ্ঠানিক পর্যায়ে জনসংযোগ কোর্স চালু করা হয় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে । পরবর্তীতে নব্বই এর দশকে যথাক্রমে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কোর্স চালু করা হয় । তার সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা এখনো জনসংযোগ বিভাগকে যথেষ্ট মর্যাদা দেয় নি ।
বাংলাদেশের জনসংযোগের যে সমস্যা তার অন্যতম কারণ জনসংযোগ সম্পর্কে ভুল ধারণা বা ভ্রান্ত ধারণা । একে কখনো বিজ্ঞাপন, কখনো হ্যান্ডশেক, বা কখনো বা পাবলিসিটি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয় । জনসংযোগ কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে প্রেস রিলিজ পাঠানোর মাধ্যমেই তাদের কর্মকাণ্ড সীমিত রাখেন । ব্যবস্থাপনার সামাজিক দর্শনের ধারণা এখানে প্রয়োগ করা হয় না ।
বাংলাদেশে জনসংযোগ সমস্যা সমূহ
১. নীতিমালার অভাব
২. ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার
৩. ভ্রান্ত মূল্যায়ন
৪. ব্যবস্থাপনায় অংশীদারিত্ব নেই
৫. তথ্য থেকে বঞ্চিত রাখা
৬. সুলিখিত নিয়ম বিধির অভাব
৭ . প্রশিক্ষণের অভাব
৮. প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব
৯. গ্রন্থের অভাব
১০ . বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের অভাব
১১. অস্পষ্ট ধারণা
১. নীতিমালার অভাব
বাংলাদেশে জনসংযোগ কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গ পেশায় পরিণত না হওয়ার প্রথম ও প্রধান কারণ হলো জনসংযোগের নীতিমালার অভাব । অধিকাংশ কর্তৃপক্ষেরই জনসংযোগ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে । তাই এর কোন লিখিত নীতিমালা নেই । যদিও আন্তর্জাতিক জনসংযোগ নীতিমালা ( Code of Ethics ) রয়েছে । কিন্তু এগুলো যথাযথভাবে পালন করা হয় না । নীতি অনুসরণ করা হয় না বলে জনসংযোগকে Crisis Mechanic Management হিসেবে চিহ্নিত করা হয় । ব্যবস্থাপনার বড় ধরনের ভুল চাপা দিতে বা জরুরী সংকটকালীন সময়ে (কান্ডারীর ভূমিকায় ) জনসংযোগের ডাকা হয় । এভাবে অর্থাৎ, জনসংযোগকে ফায়ার এলার্ম এপ্রোচ এ ব্যবহার করা হয়ে থাকে ।
২. ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার
আমাদের দেশে কোম্পানির প্রধাণরা জনসংযোগ কর্মকর্তা কে ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করে থাকেন । প্রফেসর আতিকুজ্জামান খান বলেছেন , শিল্পক্ষেত্রে , ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, কর্পোরেশন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জনসংযোগ কর্মকর্তা এমন সব কাজ করেন যার সাথে জনসংযোগের কোনো সম্পর্ক নেই । তারা যেন অবহেলিত এক সত্তা । কোম্পানির প্রধানরা তাদের নিজেদের পরিবারের কাজকর্ম করানোর জন্য ব্যবহার করে থাকে ।
৩. ভ্রান্ত মূল্যায়ন
আতিকুজ্জামান খান কে উদ্ধৃত করে বলা যায় , আমাদের দেশে জনসংযোগ পেশাজীবীদের রাশভরী ভিন্ন পদবী যেমন – ডিরেক্টর, ম্যানেজার, অফিসার , কাউন্সিলর ইত্যাদিতে ভূষিত করা হলেও ভ্রান্তভরে তাদের প্রেস এজেন্ট হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় । ব্যবস্থাপনায় দৃশ্যত তাদের কাজ হল , প্রেস রিলিজ, হ্যান্ড আউট, প্রতিবাদ , ভুল সংশোধন এবং হাজারো রকম মুখবন্ধ করা ,বিবৃতি তৈরি করা এবং তা পত্রপত্রিকায় বিলি করা ।জনসংযোগ কর্মী হচ্ছেন এমন একজন লোক যার ভুল ভ্রান্তির জন্য প্রায় চলে হস্তি-ধস্তি কিন্তু সবকিছু ঠিকঠাক চললে প্রশঙসা মেলে কদাচিৎ ।
৪. ব্যবস্থাপনায় অংশীদারিত্ব নেই
জনসংযোগ ব্যবস্থাপনারই অংশ । দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা সত্য যে, আমাদের দেশে জনসংযোগ কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সাথে জড়িত নন । বোর্ড রুমে তিনি নির্দিষ্ট শ্রোতা । প্রতিষ্ঠানসমূহে জনসংযোগ কর্মদকর্তা কোন আলোচনায় অংশগ্রহণ করা কিছু বলা, শোনা এমনকি দেখাও তার জন্য অন্যায় । তার নিজেকে সবসময় একজন বহিরাগত বলে মনে হয় ।
৫. তথ্য থেকে বঞ্চিত রাখা
জনসংযোগ কর্মকর্তা কে কখনোই সংগঠনের যাবতীয় তথ্য সম্পর্কে জানানো হয় না । তাকে সংগঠনের আভ্যন্তরীণ বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ রাখা হয় । ফলে সংগঠনে তার অবদান রাখার সুযোগ ব্যাহত হয় ।
৬. সুলিখিত নিয়ম বিধির অভাব
আমাদের দেশে অধিকাংশ সংস্থায় কোন সুসংজ্ঞায়িত কর্ম নিয়োগ নীতি নেই । যাকে দিয়ে যা কার্যসিদ্ধি হবে তাকেই জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় । জনসংযোগ বিষয়ে কোন অভিজ্ঞতা অথবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এমন লোকও হুট করে জনসংযোগ ইউনিটে কাজের দায়িত্ব পেয়ে যান । জনসংযোগের মত বিশেষায়িত কাজ করতে তারা বিপাকে পড়েন । তারা প্রায়ই জনসংযোগকে প্রচার অথবা প্রচলণার সাথে গুলিয়ে ফেলেন এবং যে সংস্থার জন্য কাজ করছেন তার স্বীকৃতি লাভে ব্যর্থ হন ।
৭ . প্রশিক্ষণের অভাব
শুধু বিশেষায়িত জ্ঞান থাকলেই হবে না । যেহেতু এটি একটি ব্যবহারিক কাজ তাই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন । আমাদের দেশে জনসংযোগ পেশাজীবিদের দক্ষতা বিকাশের সহায়ক কোন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে । তাদের যাবতীয় বিদ্যা ঠেকে শেখা । এতে অযথা সময় ও পরিশ্রম দুটোই লাগে ।
৮. প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব
দেশে পর্যাপ্ত মাত্রায় জনসংযোগের প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়া হয় না । ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একটি কোর্স ছাড়া পিআইবি স্বল্পকালীন ট্রেনিং দেয় মাত্র । অন্যান্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপকভাবে শিক্ষাটি চালু করতে হবে । অদূর ভবিষ্যতে সেরকম সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না ।
৯. গ্রন্থের অভাব
জনসংযোগের বাংলা ভাষায় বইয়ের অভাব রয়েছে । তাছাড়া যা আছে তাও বাংলাদেশের ধরনে লেখা হয় না । জনসংযোগ সমিতির জার্নাল নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হয় না । এছাড়া গবেষণাধর্মী লেখারও অভাব রয়েছে
১০ . বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের অভাব
প্রকৃত স্কলার ও এই প্রেকটিশনারের অভাব রয়েছে । অধিকাংশ শিক্ষক এ বিষয়টি পাড়াতে চান না । যারা চান তারা দিন নির্দেশনাও দিচ্ছেন না ।
১১. অস্পষ্ট ধারণা
জনসংযোগ কী এ বিষয়ে আমাদের ধারণা স্পষ্ট নয় । এটি বিজ্ঞান না কলা , প্রচার না প্রচারণা, বিজ্ঞাপন না মার্কেটিং এ ব্যাপারগুলো এখনও সবার কাছে পরিষ্কার নয় ।
আরো জানুন……….জনসংযোগ কার্যক্রমের হাতিয়ারসমূহ
বাংলাদেশে জনসংযোগ সমস্যা র সমাধান
১ . ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান খান বলেছেন, জনসংযোগ পেশার প্রতি মানুষের যে দৃষ্টিকোণ তা হঠাৎ করেই পরিবর্তন হবে না । জনসংযোগ পেশার সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য সবচেয়ে আগে যা প্রয়োজন তা হল এই পেশার প্রতি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন । তাছাড়া তিনি চারটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন । এগুলো হল-
ক . জনসংযোগ পেশাকে যথাযথ গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়া
খ . জনসংযোগ কর্মকর্তাকে কাজের উৎসাহী করে এমন কিছু কার্যক্রম হাতে নেওয়া
গ . জনসংযোগ অফিসার কে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব লোক মনে করা
ঘ . পেশাগত সন্তোষ বিধান করা
২ . ব্যবস্থাপনার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন
জনসংযোগ একটি অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ তা নিশ্চিত করতে হবে । স্বতন্ত্র ভাবে কাজ পরিচালনা করার সুযোগ দিতে হবে । যেমন- বাজেট, প্ল্যান ইত্যাদিতে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে । দিতে হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ । এভাবেই জনসংযোগ কর্মকর্তাকে সক্রিয় রাখতে হবে ।
৩. নিয়ম-নীতির প্রয়োজন
কর্তৃপক্ষের এই সত্য মেনে নেওয়া উচিত যে কোন ব্যবহারিক কর্মকাণ্ডেই জনসংযোগ অপরিহার্য । এটি একটি স্বতন্ত্র ধরনের বিশেষায়িত পেশা । তাই কারো পক্ষে এই কাজটি সুচারু ও দক্ষরূপে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় । প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পন্ন লোকের পক্ষেই সম্ভব এই দায়িত্ব যথযথভাবে পালন করা । জনসংযোগ কর্মী নিয়োগের সময় এ কথাটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে ।
৪. আর্থিক সুবিধা প্রদান
জনসংযোগ কর্মকর্তা কে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হলে জনসংযোগ কর্মীকে উন্নততর আর্থিক সুবিধাদি দিতে হবে । যাতে করে সুযোগ্য ও মেধা সম্পন্ন লোকজন এ পেশায় এগিয়ে আসেন । যার জন্য পুরস্কার, প্রোমোশন, বোনাস ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকতে হবে । বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে । এর সাথে জনসংযোগ কর্মীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হবে ।
৫. জনসংযোগ পেশা কে বিশেষায়িত পেশা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে । ডাক্তার বানানোর জন্য যেমন মেডিকেল কলেজের দরকার হয় তেমনি জনসংযোগকেও বিশেষীকৃত পেশা হিসেবে দেখে অবিলম্বে দেশে একটি জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে ।
৬ . জনসংযোগ কর্মকর্তা কে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মনে করতে হবে । যার উপর সংগঠনের ভালো-মন্দ অনেক কিছু নির্ভর করে ।
No comments