প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ কী । প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগের অ্যাপ্রোচ

প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ কী? প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগের অ্যাপ্রোচগুলো


প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ Organizational Communication


প্রতিষ্ঠান ছাড়া আজকের বিশ্ব কল্পনা করা যায় না। একক প্রচেষ্টায় আজ কেউ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, পরিবহন, প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে না। একক–আদিম, অপরিকল্পিত প্রচেষ্টার চেয়ে সম্মিলিত, সমন্বিত, পরিকল্পিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত কার্যকর। যোগাযোগবিদগণ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নানা ধরনের সংজ্ঞার অবতারণা করেছেন।


যোগাযোগবিদ জোসেফ এ ডেভিটো তার Human Communication বইয়ে প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন–

নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংগঠিত একদল লোককে প্রতিষ্ঠান বলে।

এবার আমাদের জানা দরকার প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ কী।


Fredrick William তাঁর The New Communication বইতে বলেন,

বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা ও প্রশাসনিক কর্ম সম্পাদনের জন্য একদল লোকের মধ্যে যে যোগাযোগ সংগঠিত হয়, তাকে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ বলে।


আবার জোসেফ এ ডেভিটো তার Human Communication বইয়ে বলেছেন—

“Organizational communication refers to the message sent and received within the organization’s formal and informal groups”


মোটকথা, প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ হচ্ছে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠিত একদল লোককে কতগুলো ব্যক্তির মধ্যে নিষ্পন্ন যোগাযোগ। 


প্রতিষ্ঠান ভেদে লোকসংখ্যার তারতম্য থাকতে পারে। যেমন, ব্রাক, ইউনিসেফ, এফবিআই প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লোকসংখ্যা ২-৪ হতে পারে। অথবা তারও বেশি হতে পারে। প্রতিষ্ঠান ভেদে কাজের ভিন্নতা দেখা যায়। আবার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক কাঠামো থাকে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যের মধ্যেও ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়।

যেমন- একটি মুনাফাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হচ্ছে মুনাফা অর্জন। অন্যদিকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য অর্থ উপার্জন নয়; অর্থ উপার্জন তাদের গৌণ লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।




প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ


প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগের অ্যাপ্রোচ


প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত এপ্রোচ চার ধরনের , যথা-

১) বৈজ্ঞানিক অ্যাপ্রোচ (scientific approach)

২) মানবিক অ্যাপ্রোচ (human relations approach)

৩) প্রক্রিয়াগত অ্যাপ্রোচ (systems approach)

৪) সাংস্কৃতিক অ্যাপ্রোচ (cultural approach)



১) বৈজ্ঞানিক এপ্রোচ

বৈজ্ঞানিক অ্যাপ্রোচ অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বাড়াতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করা উচিৎ। এক্ষেত্রে দুটি বিষয়ের উপর জোর দিতে হবে৷

কাজের ভৌত চাহিদা (physical demand of the work)

শ্রমিকদের শারীরিক সক্ষমতা (physiological capabilities of the workers)


Fedrick W. Taylor তাঁর Scientific Management গ্রন্থে এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি কয়লা খনির শাবলের আকৃতির উপর গবেষণা করে শাবলের একটি নির্দিষ্ট আকার নির্ধারণ করে দেন এবং এতে দেখা যায় আগের চেয়ে কম শ্রমিক দিয়ে একই কাজ করা যাচ্ছে। কোনো চাকুরির ভৌত চাহিদা এবং শ্রমিকের শারীরিক  ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে এই অ্যাপ্রোচটি দেখানো হয়েছে।

এখানে শ্রমিকেরা তাদের ব্যক্তিগত কর্মক্ষমতা অনুযায়ী মজুরী পান এবং এখানে শ্রমিকদেরকে কোনো মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হয় না। বস্তুত , এটি একটি পরিপূর্ণ Reward system. অ্যাপ্রোচটিতে যোগাযোগকে আদেশ এবং কার্যপ্রণালীর ব্যাখ্যা হিসেবে দেখানো হয়েছে। একে খুব কঠিন অ্যাপ্রোচ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এতে মালিক এবং শ্রমিকের সম্পর্ক আদেশ দেয়া এবং পালন করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। এ অ্যাপ্রোচে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে।

Organizational Communication Category


সীমাবদ্ধতা বা সমালোচনা

ক) এই অ্যাপ্রোচটিকে কাজের ভৌত চাহিদা এবং শ্রমিকের শারীরিক ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখানো হয়েছে।

খ) এই অ্যাপ্রোচটিতে শ্রমিকদেরকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হয় না।

গ) এটি reward system অ্যাপ্রোচ

ঘ)   মালিক এবং শ্রমিকের সম্পর্ক আদেশ দেয়া এবং পালন করার মধ্যে সীমাবদ্ধ 

ঙ) এটি খুব কঠিন অ্যাপ্রোচ


২) মানবিক অ্যাপ্রোচ

বৈজ্ঞানিক অ্যাপ্রোচের বিপরীত ধারণা নিয়ে মানবিক অ্যাপ্রোচ প্রতিষ্ঠিত। এ অ্যাপ্রোচে শ্রমিকদের সামাজিক সমস্যা (social factor) এবং শারীরিক সমস্যা (physiological factor) –কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এ অ্যাপ্রোচের আপ্তবাক্য হচ্ছে— ‘A happy worker is a productive worker’


এই অ্যাপ্রোচের মতে শ্রমিকদের সন্তুষ্টির উপর প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন নির্ভর করে। শ্রমিকদের সন্তুষ্ট করতে পারলেই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। পরিচালনায় সংশ্লিষ্টদের শ্রমিকদের সন্তুষ্ট রাখতে হয়। পরিচালককে শ্রমিক নেতাদের প্রভাবিত করতে হয় যাতে তারা বাকি শ্রমিকদেরকে সন্তুষ্ট রাখতে পারে।

ফলে একটি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এই অ্যাপ্রোচটিতে সামাজিক, আনুষ্ঠানিক গ্রুপগুলোর প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে এবং এই সমস্ত গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের বিশেষ সুযোগ করে দেয়।


তবে এই অ্যাপ্রোচটির কিছু দূর্বল দিকও রয়েছে। এখানে ধরে নেয়া হয়েছে, উৎপাদন বাড়ানোর জন্য শ্রমিকের খুশিই বেশি প্রভাব রাখে। কিন্তু শুধু শ্রমিকের মন রক্ষাই কি উৎপাদন বাড়ানোর মূল শর্ত হতে পারে, এটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এখানে দ্বন্দ্ব, প্রতিযোগিতাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এখানে যোগাযোগকে দেখানো হয়েছে মানবিক সম্পর্কের সরঞ্জাম হিসেবে।


৩) প্রক্রিয়াগত অ্যাপ্রোচ

প্রক্রিয়াগত অ্যাপ্রোচকে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখানো হয়। বৈজ্ঞানিক এবং মানবিক অ্যাপ্রোচের শ্রেষ্ঠ উপাদানগুলোকে সমন্বয় করে এই অ্যাপ্রোচটি। এই প্রক্রিয়ায় উপাদানগুলো একে অপরকে প্রভাবিত করে। এখানে দুটি পদ্ধতি রয়েছে। একটি হচ্ছে

উন্মুক্ত প্রক্রিয়া (open system),

আরেকটি হচ্ছে বন্ধ প্রক্রিয়া (close system)

উন্মুক্ত প্রক্রিয়ায় পরিবেশের যেকোনো প্রতিক্রিয়ায় সংস্থা ইতিবাচকভাবে সাড়া দেয়। ফলে সংস্থাটি গতিশীল হয়। বন্ধ প্রক্রিয়ায় এর উল্টোটি ঘটে। এখানে যোগাযোগ খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ; কেননা যোগাযোগের মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়াটি জীবন্ত থাকে। এই প্রক্রিয়া অনুযায়ী একটি সংস্থা তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত সকল অংশের সমষ্টির চেয়েও জটিলতর।

পুরো উন্নয়ন প্রক্রিয়া যেহেতু দলগত কাজের ব্যাপার, তাই এখানে শ্রমিকরা একত্রিত হয়ে কাজ করবে, এর ফলাফল তাদের কাজ করতে আরো উদ্বুদ্ধ করবে।এই অ্যাপ্রোচ গণতান্ত্রিক নেতৃত্বকে উৎসাহিত করে। এই অ্যাপ্রোচে প্রতিষ্ঠানকে দেখা হয় জটিল প্রক্রিয়া হিসেবে।


৪) সাংস্কৃতিক অ্যাপ্রোচ

এই অ্যাপ্রোচটিতে কোনো প্রতিষ্ঠানকে সমাজ বা সংস্কৃতি হিসেবে দেখা হয়। একটি সামাজিক গোষ্ঠী অথবা সংস্কৃতির যেরূপ নিজস্ব প্রথা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ থাকে, একটি প্রতিষ্ঠানেরও এরূপ থাকে। এই অ্যাপ্রোচে একটি প্রতিষ্ঠানকে তার নিজস্ব সংস্কৃতি চিহ্নিত করতে খতিয়ে দেখা হয়। পরিণামে এই অ্যাপ্রোচটির মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানের দূর্বলতা এবং করণীয় চিহ্নিত করা হয় এবং কিভাবে প্রতিষ্ঠানটি লাভবান হবে, তাও দেখানো হয়।

একই মূল্যবোধ এবং লক্ষ্য নিয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের ঐ প্রতিষ্ঠানে একধরনের নাগরিক অধিকার থাকে, যেটি থাকে দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে। দেশের একজন নাগরিক যেমন তার জন্মভূমির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি সাধনে ভূমিকা রাখে এবং তার ফল ভোগ করে, অনুরূপভাবে, একটি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের সমৃদ্ধির জন্য কাজ করে এবং তার ফল ভোগ করে।

এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিতে যোগাযোগকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছে। শ্রমিকদের সাথে ম্যানেজার, ম্যানেজারের সাথে এমডির যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যোগাযোগ এখানে আলাদা কিছু নয়, প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যোগাযোগ গড়ে ওঠে।

No comments

Powered by Blogger.